তাঁর মাথায় ক’টা চুল আছে জানতে চেয়েছিলেন কলেজের কয়েক জন ছাত্র! সদ্য ভর্তি হওয়া ছেলেটি কাঁপা-কাঁপা গলায় উত্তর দিয়েছিল,“সাতচল্লিশ হাজার!” অভিযোগ, তখনই উল্টোদিক থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে আশালীন গালিগালাজের ফোয়ারা ছুটেছিল। সেই ছেলেরা বলেছিলেন, “সকালে স্নানের সময় তো তোর তিনটে চুল উঠে গিয়েছে। তার পরও সংখ্যাটা কী করে একই থাকে?”
কখনও আবার কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের ভুগোলের স্নাতকোত্তরের নতুন পড়ুয়াটির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সাইকেলের চাবি। জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘এটা কী?’ সঠিক উত্তর দেওয়ায় একই ভাবে শুরু হয়েছিল গালি!
এতেও ক্ষান্ত হননি সেই হেনস্তাকারীরা। অভিযোগ, এর পর তাঁকে মোবাইলে একটা অশ্লীল ছবি দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয়, অভিনেত্রীর নাম কী? উত্তর না- পাওয়ায় আবার শুরু হয় গালি আর হেনস্থা। এই ভাবে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে নির্যাতন।
তারই এক ফাঁকে সুযোগ পেয়ে সেই পড়ুয়া মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গির সাদিখারদেওয়ার গ্রামের বাসিন্দা মফিকুল শেখ নিজের মোবাইল থেকে একশো নম্বরে ডায়াল করেন। সেখান থেকে তাঁকে জেলা পুলিশের একটা নম্বর দেওয়া হয়। সেখানে ফোন করে তিনি গোটা ঘটনাটি জানান। এই ঘটনা গত শনিবারের।
এরই মধ্যে আবার শুরু হয় অত্যাচার। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যে চলে আসে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। হস্টেলের দাদারা পুলিশকে জানিয়ে দেন, ‘‘কোথাও কোনও সমস্যা নেই।’’ পুলিশ তখনকার মতো চলে যায়। এবং অভিযোগ, পুলিশকে জানানোর জন্য মফিকুলকে জানে মেরে দেওয়ার হুমকি দেন ওই দাদা-রা। কিন্তু কিছু সময় পরে পুলিশ আবার ফিরে এসে সোজা হস্টেলে ঢুকে পড়ে। তখনই পুলিশকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন মফিকুল। পুলিশ তখন হস্টেলের সমস্ত আবাসিকদের ডেকে এনে মফিকুলকে দোষীদের শনাক্ত করতে বলে। তিনি সাত জনকে শনাক্ত করেন। এঁরা মূলত ওই কলেজের বিএ-ক্লাসের পড়ুয়া। এঁদের সঙ্গে এক জন এমএ পড়ুয়া ও এক জন বহিরগত ছিলেন বলে তাঁর দাবি। মফিকুলের কথায়, “পুলিশ সাত জনের ছবি তুলে নেয়। জেনে নেয় নাম-ঠিকানা। আমি পুলিশকে অনুরোধ করি, আমাকে যেন তাঁরা হস্টেলে রেখে না-যান। তা হলে ওই ছেলেরা আমাকে মেরে ফেলবে। তখন ওঁরা আমাকে থানায় নিয়ে যান।” রাতেই পুলিশ ফোন করে মফিকুলের বাবা-মাকে। গত রবিবার সকালে মফিকুলের বাবা-মা এসে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান। বাড়ি ফিরে তাঁরা কলেজের র্যাগিং-বিরোধী কমিটিকে মেল করে গোটা বিষয়টি জানায়। এর পরই কমিটির পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়। কলেজের অধ্যক্ষ ফোনে যোগাযোগ করেন মফিকুলের সঙ্গে।
ঝাড়খণ্ডের সিধু-কানু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে এমএ তে ভর্তি হয়েছিলেন মফিকুল । শনিবার থেকে তিনি কলেজের হস্টেলে থাকতে শুরু করেন। অভিযোগ, ওই দিন রাতেই শুরু হয় র্যাগিং। চরম দারিদ্র্রের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছেন মফিকুল । বাবার ছোট্ট চায়ের দোকান। এ দিন তার সঙ্গে কলেজে এসেছিলেন মা সানুয়ারা বিবি। চোখ মুখে একরাশ উদ্বেগ। তাঁর কথায়, “আমরা চাই ছেলে কলেজের হস্টেলে থেকে পড়ুক। কিন্তু এত কিছুর পরে খুব ভয় লাগছে। ওরা যদি কোনও ক্ষতি করে দেয়।” যদিও র্যাগিয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত প্রশান্ত পোদ্দার, অসীম বিশ্বাস। তাঁদের দাবি, “অভিযোগ মিথ্যা। মফিকুল প্রথম দিন এসেছে। আমরা ডেকে হস্টেলের নিয়মকানুন বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম মাত্র।”
এ দিনই কলেজের র্যাগিং-বিরোধী কমিটিকে নিয়ে বৈঠকে বসেন অধ্যক্ষ শোভন নিয়োগী। কথা বলেন দুই পক্ষের সঙ্গে। তিনি বলেন, “পুলিশকে জানানের পাশাপাশি ইউজিসির নির্দেশিকা মেনে পদক্ষেপ করা হবে।’’ পুলিশ জানায়, কলেজ অভিযোগ করলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।