প্রতীকী ছবি।
নদিয়া জুড়ে যে প্রায় ৪৮ হাজার ২০০ চাষিকে বিনা পয়সায় ফলের চারা দেওয়ার তোড়জোড় করছে জেলা প্রশাসন, তাঁদের অনেকেই কী করে তালিকায় ঢুকলেন তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, বেনিয়মের অভিযোগ উঠছে জেলা প্রশাসনের তরফে চারা কেনার দর নিয়েও।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে প্রায় প্রস্তুত তালিকা ধরে চারা বিলি করতে হলে বহু লক্ষ চারা কেনার বরাত দিতে হবে। গোটা টাকাটাই দেবে জেলা প্রশাসন। চারা কেনার জন্য কয়েকটি সংস্থাকে নির্দিষ্ট করাও হয়েছে। অনেক পঞ্চায়েতেরই কর্তারা জানাচ্ছেন, নারকেলের সঙ্গে যেহেতু লেবু ও পেঁপে চাষ করা যাবে, সেই কারণেই তালিকায় যে আগ্রহী চাষিরা রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নারকেলের চারা চাইছেন।
গত বছর ২২ অগস্ট নদিয়ার ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের নোডাল অফিসার অর্ণব রায় জেলার সব বিডিও-কে (তাঁরাই ব্লক স্তরে প্রকল্পের প্রোগাম অফিসার) চিঠি দিয়ে চারা কেনার কথা জানান। চারা জোগানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড হর্টিকালচার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন-কে। কিন্তু সপ্তাহ দুই আগে ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের নদিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রোগাম কো-অর্ডিনেটরের চিঠি আসার পরেই বিতর্ক দানা বেঁধেছে।
অগস্টের চিঠিতে বলা হয়েছিল, পঞ্চায়েতগুলি ওই কর্পোরেশন-কে বরাত দেবে। কম উচ্চতার একটি জাত ছাড়াও আরও দুই জাতের (ইসিটি, ডব্লিউসিটি) চারার দাম ধরা হয়েছিল ৬৫ টাকা। কিন্তু গত ২১ জানুয়ারি অতিরিক্ত জেলা প্রোগাম কো-অর্ডিনেটরের চিঠিতে একটি নারকেল চারার দর ধরা হয়েছে ২৬০ টাকা। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, ১০০ দিন প্রকল্পের কাজের আনুমানিক খরচ হিসেব করার জন্য ‘সিকিওর’ নামে একটি সফটঅয়্যার ব্যবহার করা হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, কোনও জেলা বা সরকারি সংস্থা সর্বোচ্চ ২৬৮ টাকা ৮০ পয়সা দরে কম উচ্চতার নারকেল চারা কিনতে পারে। তবে দর নির্দিষ্ট নয়। টেন্ডার ডেকে চারা জোগানের বরাত দিতে হবে, এটাই নিয়ম।
কর্পোরেশনের এক কর্তা বলছেন, ‘সিকিওর’-এ উল্লিখিত দর সব ক্ষেত্রে বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। কোনও জিনিসের দর নিজেদের মতো ঠিক করে তা ওই সফটঅয়্যারে নথিভুক্ত করাও জটিল নয়। ফলে দরপত্র করার সময়ে ‘সিকিওর’-কে ধ্রুব বলে ধরা হয় না। কয়েক মাস আগেই তাঁরা যে নারকেলের চারা মাত্র ৬৫ টাকায় দিয়েছিলেন, এখন তার দর কী করে চার গুণ বাড়তে পারে?
এ বারের প্রকল্পে দরপত্র করানোর দায়িত্বে ছিল পশ্চিমবঙ্গ কম্প্রিহেনসিভ এলাকা উন্নয়ন নিগমের বহরমপুরের অফিস। সেই অফিসই মুর্শিদাবাদের তিনটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে নদিয়ায় গাছের চারা জোগানের দায়িত্ব দিয়েছে বলে ২১ জানুয়ারির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্লক স্তরের অনেক আধিকারিকই দাবি করছেন, অগস্টের তুলনায় লেবু, পেঁপে ও ‘জি-৯’ জাতের কলার চারার দরও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে নারকেলের লাফিয়ে ওঠা দর। কর্পোরেশনের এক কর্তা বলছেন, ‘‘আমরা আগে ৬৫ টাকায় নারকেলের চারা দিয়েছিলাম। এ বারও যদি আমাদের জোগানের দায়িত্ব দেওয়া হত, দরের খুব একটা তারতম্য হত না। কয়েক মাসের মধ্যে অতিরিক্ত তারতম্য হওয়ার কথাও নয়।’’
প্রশ্ন উঠছে চার গুণ বেশি দামি সেই সব নারকেল চারার মান নিয়েও। কেননা গাছের উচ্চতা ও চারার বয়স চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে বরাত পাওয়া সংস্থাগুলি পঞ্চায়েতকে যা দেবে, তা-ই নিতে হবে বলে আশঙ্কা অনেক পঞ্চায়েতের কর্তাদেরই। তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের একটি ‘ফরম্যাট’ দেওয়া হয়েছে, যেখানে লেখা রয়েছে ‘সঠিক সংখ্যায় ও সঠিক গুণগত মানের চারা বুঝিয়া পাইলাম’— এই মর্মে পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক, এগজ়িকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও প্রধানকে সই করতে হবে। নির্মাণ সহায়কেরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমাধারী। জোগানদার সংস্থা কী জাতের নারকেল, গন্ধরাজ লেবু, পেঁপে বা কলার চারা দিল তা বোঝা তাঁদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব।
কল্যাণীর একটি বড় নার্সারির মালিক সুদীপ সরকারের মতে, ‘‘সত্যি করেই বাগিচা ফসলের বিশেষজ্ঞ ছাড়া এটা কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।’’ নারকেল বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই চিঠিতে কেরলের প্রজাতির ছোট আকারের নারকেল চারা বলে যা উল্লেখ করা রয়েছে, তার কোনও নির্দিষ্ট অর্থ নেই। কেননা কেরলে ছোট আকারের বহু নারকেল গাছের জাত আছে। তাই এক কথায় ‘কেরালিয়ান ভ্যারাইটি’ বললে কিছু বোঝায় না। ওই সব ‘ভ্যারাইটি’র একটির সঙ্গে আর একটির দরেরও ফারাক রয়েছে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানপালন অনুষদের শিক্ষক তথা দীর্ঘদিনের নারকেল গবেষক দীপক ঘোষ আবার বলছেন, ‘‘ছোট উচ্চতার ওই সব প্রজাতি আমাদের এখানে ভাল ফল দেয় না। ফুল এলেও ফল আসে না। এর আগে সল্টলেকের নলবনের আশপাশে বহু ভেড়ির ধারে এই জাতের নারকেল চাষ হয়েছে। সেখানকার অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। এই চারা দিয়ে চাষিদের কতটা লাভ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’’
ন্যাশনাল কোকোনাট বোর্ডের এক আধিকারিকের মতে, দক্ষিণ ভারতের গরম আবহাওয়ায় ছোট উচ্চতার যে নারকেল গাছ ভাল ফল দেয়, গোটা পূর্ব ভারতে তা মোটেই ভাল ফল দেয় না। তার মান এবং উৎপাদনশীলতাও কম। অনেকেই বাড়ির বা বাগানের শোভাবর্ধনের জন্য ওই চারা লাগান। কিন্তু চাষিদের জন্য এটা মোটেই কার্যকরী নয়। অথচ সেই চারাই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬০ টাকা। ন্যাশনাল কোকোনাট বোর্ডের ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘লম্বা গাছ হবে এমন জাতের নারকেলের চারা দিব্যি ৬০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। তাতে চাষির লাভ হত। ২৬০ টাকা দামটাও যে বড্ড বাড়াবাড়ি ঠেকছে!’’
তবে গোটা প্রক্রিয়াটি যিনি নিজে পরিচালনা করছেন, সেই জেলাশাসক বিভু গোয়েল শুধু বলেন, ‘‘সিকিওর সফটঅয়্যার অনুযায়ীই দর ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে বেনিয়মের কোনও ব্যাপারই নেই।’’