ঝুলনের পুতুল। নবদ্বীপে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
“মাহ শাওন, করিব ঝুলন লাড়িলি কুণ্ডের তীরে। মণ্ডলী মণ্ডলী সহচরী মিলি কিশোরীকে করি সঙ্গে, নাচিব গাহিব, ঝুলিব ঝুলাব বিহরিব মনোরঙ্গে।” ঠিক দু’বছর পর বৈষ্ণব পদাবলীর সুরে সুর মিলিয়ে চেনা ঝুলন রঙ্গে মেতে উঠেছে নবদ্বীপ। করোনার জন্য গত দু’বছর সে ভাবে ঝুলন উদ্যাপনের সুযোগ ছিল না। সম্পূর্ণ মুক্ত না-হলেও অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত এখন করোনা। তাই উৎসবের ছবি সেই আগের মতোই।
পঞ্জিকার হিসেবে ঝুলন পাঁচ দিনের উৎসব। কিন্তু নবদ্বীপের সব কিছুই স্বতন্ত্র। নিজস্ব ঢঙে প্রচলিত রীতি মেনে ঝুলন উৎসব এ খানে শুরু হয় শ্রাবণের শুক্লা প্রতিপদ থেকেই। চলে পনেরো দিন ধরে। বারো মাসে তেরো পার্বণের নবদ্বীপের ছোট বড় মঠমন্দির থেকে শুরু করে ক্লাব বারোয়ারি এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ঝুলন উদ্যাপন হয় প্রবল আড়ম্বরে। উৎসব এবং পর্যটন নির্ভর স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্যকে বর্ষার মন্দা মরশুমে বেশ খানিকটা রসদ যোগায় এই ঝুলন। রাস বা দোলের মতো নয়, পাঁচ দিনের ঝুলনযাত্রা বর্ণময়তা, বৈচিত্র্যে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মেজাজের উৎসব। একটা সময় ছিল যখন গঙ্গার পূর্ব-পশ্চিম দু’পাড় আক্ষরিক অর্থেই বারো মাসে তেরো পার্বণে মেতে থাকত। তা ছাড়া উপায় কী? তাঁতশিল্প ধ্বংস হওয়ার পর থেকে উৎসবেই রুটিরুজির সংস্থান করে নবদ্বীপ। বছরভর উৎসব ঘিরেই আবর্তিত হয় নবদ্বীপের অর্থনীতি। যেমন এই ভরা শ্রাবণে পক্ষকাল জুড়ে নবদ্বীপ ঝুলনে মেতে উঠত। বর্ণময়তা, বৈচিত্র্যে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মেজাজের ঝুলন অবশ্য অতিমারির কালে হারিয়েছিল যাবতীয় রং। গত দু’বছর ধরে নিয়মরক্ষার উৎসব এ বার স্বমহিমায় পালিত হবে।
পনেরো দিনের ব্যতিক্রমী সেই ঝুলনের সূচনা হল শুক্রবার থেকে। নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দির, সমাজবাড়ির মতো বিশিষ্ট মন্দিরগুলিতে ঝুলন উৎসবের ব্যাপ্তি পক্ষকালের। মহাপ্রভু মন্দিরের পরিচালন সমিতির পুলক গোস্বামী বলেন, “ঝুলনের উৎসব চলে প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত। ঝুলন এখানে রাধাকৃষ্ণের নয় মহাপ্রভুর।’’
এই প্রসঙ্গে প্রবীণ সেবায়েত লক্ষীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “ঝুলন আদতে বৃন্দাবনের উৎসব। সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় হিন্দোল উৎসব। কিন্তু বৃন্দবনের ঝুলন নবদ্বীপে আমূল বদলে গিয়েছে। দুই উৎসবের প্রথম তফাৎ দর্শনে, দ্বিতীয় তফাৎ অঙ্গ স্বাতন্ত্রে। নবদ্বীপে উৎসবের ব্যাপ্তি বিশাল। ব্রজে যা ছিল সীমাবদ্ধ নবদ্বীপে তা আপামরের জন্য উন্মুক্ত। তাই নবদ্বীপের ঝুলন ভিন্নতর।” দু’বছর পর এ বার ফের পনেরো দিন ধরে ঝুলন কীর্তন ও পাঠের বিশেষ আসর বসা শুরু হল শুক্রবার থেকে। মন্দির পরিচালন সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলেন, “দু’বছর বন্ধ থাকার পর মহাপ্রভুর ঝুলন ভিড় উপচে পড়তে পারে সেই অনুমানে এবার ভিড় নিয়ন্ত্রণে থাকছে পুলিশ।”
অন্য দিকে, নবদ্বীপ সমাজবাড়ির ঝুলন তেরো দিনের। বৃন্দাবনের গোস্বামী মতে এখানে ঝুলনযাত্রা উদ্যাপন করা হয়। প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত হয় সায়ংকালীন ঝুলন। আর একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সারারাত ঝুলন কীর্তন হয়। সঙ্গে সখী বেশে অভিনয়। কীর্তনে যা বলা আছে তাই অভিনয় করা হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কোভিড বিধি মেনে দু’বছর সাধারণের যোগদান নিয়ন্ত্রিত ছিল। এ বার উৎসব সকলের জন্য।”