‘সাবধানে বাবা’, পুলকার চলছে

মা বলছেন, ‘‘টিফিন নিয়েছো, সাবধানে, গাড়ির বাইরে হাত বার কোর না বাবা, টা টা...’’—এক ঝাঁক হুল্লোড়ে কচি-কাঁচা সমেত ছুটন্ত পুলকার আর তার পাশেই দুমড়ে যাওয়া গাড়ির ছবি— বিজ্ঞাপনটা নতুন নয়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০১:৩১
Share:

এ ভাবেই যাতায়াত করে পুলকার। বাঁ দিকে, বহরমপুরের কর্ণসুবর্ণে লছিমনে স্কুলের পথে পড়ুয়ারা (ফাইল চিত্র)। ডান দিকে শান্তিপুরের পথে পুলকার। —নিজস্ব চিত্র।

মা বলছেন, ‘‘টিফিন নিয়েছো, সাবধানে, গাড়ির বাইরে হাত বার কোর না বাবা, টা টা...’’—এক ঝাঁক হুল্লোড়ে কচি-কাঁচা সমেত ছুটন্ত পুলকার আর তার পাশেই দুমড়ে যাওয়া গাড়ির ছবি— বিজ্ঞাপনটা নতুন নয়।

Advertisement

পুলকারে পড়ুয়াদের সঁপে দিয়ে দুরু দুরু অভিভাবকদের হৃদকম্পন কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট দামী সেই বিজ্ঞাপনটা হালফিলে প্রায়ই অব্যর্থ হয়ে উঠলেও হুঁশ ফেরেনি পুলিশ কিংবা অভিভাবক—কারও। বরং সেই অস্বস্তি নিয়েই ‘আর কিসেই বা স্কুলে পাঠাব’ গোছের আলগোছে মন্তব্যের পরে তাঁরা পুরনো অভ্যাস ছাড়ছেন না।

আর তার জেরেই কখনও ট্রাফিক আইন ভেঙে অন্য লাইনে ঢুকে পড়া পুলকার মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছে অতিকায় লরির কখনও পুলকার হিসাবে ব্যবহার করা মোটরচালিত তিন চাকার ভ্যান বেবাক উল্টে যাচ্ছে জাতীয় সড়কে। যার মাসুল গুনছে খুদে পড়ুয়ারা।

Advertisement

মাস কয়েক আগে এই লেন-ভাঙারই খেসারত গুনেছিল পশ্চিম দিনাজপুরের চাকুলিয়া। উল্টো দিক থেকে এসে পড়া লরির ধাক্কায় নিমেষে দুমড়ে-মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল পড়ুয়া বোঝাই পুলকার’টা। মারা গিয়েছিল দশ জন।

দিন কয়েক আগে, তেলেঙ্গানাতেও একই ভাবে মারা গিয়েছিল ১৭ জন স্কুল পড়ুয়া। সেই তালিকায় রয়েছে নদিয়ার ভাতজংলা কিংবা কৃষ্ণনগরের কাছে দেপাড়া। যেখানে রাস্তার বাঁকে উল্টো দিক দিয়ে আসা বাসের ধাক্কায় পড়ুয়া বোঝাই ছোট গাড়ির মুখোমুখি ধাক্কায় মারা গিয়েছে পাঁচ পড়ুয়া। ট্রাডিশনটা ভাঙেনি।চলছেই।

বৃহস্পতিবার সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে যানজট এড়াতে নিয়ম ভেঙে তেমনই, অন্য লেনে ঢুকে গিয়েছিল পুলকারটি। সেই সময় উল্টো দিন থেকে আসা একটি লরির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কায় মারা যায় তিন জন পড়ুয়া। জখম হয় আরও ছ’জন।

বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনার পর পুলকার নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠেছে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে। তবে এমন দাবি প্রিতিটি ঘটনার পরেই ওঠে। ঈবার হারিয়েও য়ায়।

অভিভাবক থেকে শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষা দফতরের কর্তারাও বেসরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে পুলকার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছেন বটে, কিন্তু তা আদতে কতটা মানা হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে ।

সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের জেলা সম্পাদক দুলাল দত্ত বলছেন, “কলকাতায় পুলকার চলাচলের ক্ষেত্রে পরিবহন দফতরের অনুমতি নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু জেলায় তো তেমন চল নেই। বিপত্তিটা সেখানেই। ’’ তিনি জানান, ছাত্রের সংখ্যা বাড়ার ফলেই এই ধরনের বেআইনি পরিবহন ব্যবহারও বেড়েছে। তাঁর দাবি, ‘‘বহু স্কুলে লছিমন এমনকী ম্যাজিক গাড়িতে ছাত্র বহনের ব্যবস্থা করে খোদ স্কুলগুলিই।’’

তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠনের জেলা সভাপতি সেখ ফুরকান অন্তত এই জায়গায় তাঁর বিরোধীর সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন, ‘‘গ্রামে গঞ্জে অজস্র বেসরকারি স্কুল গজিয়ে উঠেছে। শিক্ষা দফতর থেকে অনুমতি নিয়েই এগুলি চলছে। কী আর বলব!’’

জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ আশিস তেওয়ারি অবশ্য বলেন, “ফারাক্কার যে স্কুলের ছাত্র পরিবহনে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তারা জানিয়েছে বাইরে থেকে ছাত্র পরিবহনের দায় তাদের নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই অভিভাবকেরা গাড়ি ঠিক করে ছাত্রদের স্কুলে পাঠান।’’

সেই সুরেই ফরাক্কার বিধায়ক মইনুল হক বলেন, “সর্বত্রই ছাতার মত গজিয়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল। আর সেখানে পড়তে দূর দুরান্ত থেকে একটা গাড়িতে গাদাগাদি করে আসছে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো। দেখেই মনে হচ্ছে এই রে, দুর্ঘটনা না ঘটে।’’ মাঝে মাঝে তাই বাস্তব হয়ে উঠছে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরাও বলছেন, ‘‘আমরা তো আর ছাত্রদের আসতে বারণ করতে পারি না। তবে কি জানেন, যে ভাবে ওদের নিয়ে আসা হয় তা দেখে অস্বস্তিই হয়।’’

জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক মনিরুদ্দিন মন্ডল বলছেন, “এ জেলায় বেশির ভাগ ছোট গাড়ি চলছে বেআইনি ভাবে। প্রাইভেট গাড়িগুলিকে পুলকার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে চালক হিসেবে যাদের নিয়োগ করা হচ্ছে তাদের গাড়ি চালানোর দক্ষতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।’’

নদিয়া জুড়েও পুলকারের ব্যবহার নিয়ে একই অভিযোগ রয়েছে। তবে এক অভিভাবকই বলছেন, ‘‘আসলে কী জানেন তো, আমরা বলি বটে নিরাপত্তার কথা, কিন্তু নিজেরাই নিজেদের ছেলে-মেয়েদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি!’’

সেই সচেতনতা না ফিরলে এই দুর্ঘটনা কি তাহলে চলবেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement