তদন্ত: কুকুর নিয়ে এসে তদন্ত বগুলায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
তাঁরই হাত ধরে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নিরীহ একটা গ্রাম— ভায়না। ‘‘ভাল না মন্দ, তা বলতে পারব না। তবে, তাঁর তৎপরতার সূত্রেই এই এলাকায় শুরু হয়েছিল শক্তিমানের রাজনীতি’’, বলছেন জেলা তৃণমূলের এক তাবড় নেতা।
রবিবার রাতে, তৃণমূলের হাঁসখালি ব্লক সভাপতি সেই দুলাল বিশ্বাস খুন হয়ে গেলেন।
বন্দরের সামান্য চাকুরে ছিলেন দুলাল। তবে, চেনা দুলালের বদলে যাওয়াও দেখেছিলেন গ্রামবাসীরা। সতেরো বছর আগে, বন্দরের চাকরি ছেড়ে গ্রামে পাকাপাকি ভাবে এসে গুছিয়ে বসেছিলেন তিনি। তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা বলছেন, ‘‘দুলাল আর ওঁর ভাই স্বপন, দু’জনে মিলে শুরু করেছিল এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের কারবার। লোকে বলত, স্বপন-দুলালের দল!’’
দুলালের বিরোধীরা দাবি করেন, অদূরের সীমান্ত থেকে আসত হরেক কিসিমের মালপত্র। তবে বেশির ভাগটাই এ পার থেকে উজিয়ে যেত ও পারে। তখন দুলাল সিপিএমে। হাঁসখালির তৎকালীন বিধায়ক, উদ্বাস্তু-পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী নয়ন সরকারের ঘনিষ্ঠও হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জিতেও যান। তাঁর বোন, রমা বিশ্বাস জেতেন পঞ্চায়েত সমিতিতে। সেই নয়ন সরকার এখন দাবি করছেন, ‘‘প্রথম দিকে দুলাল দলের হয়ে কাজ করত ঠিকই, তবে পরে ও বিভিন্ন অসামাজিক কারবারে জড়িয়ে পড়েছিল বলে শুনেছি।’’
সীমান্তের কারবারের রমরমার মধ্যেই, ২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি খুন হয়ে যান স্বপন। হাঁসখালিতে তখন বিরোধী নেতা বলতে বগুলার কংগ্রেস নেতা শশাঙ্ক বিশ্বাস। সিপিএমের ভরা বাজারে বগুলায় তখন যথেষ্ট দাপট প্রাক্তন ওই বিধায়কের। বগুলা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতও তখন ছিল তাঁদের দখলে। সিপিএমের প্রচারে স্বপন-হত্যা রাজনৈতিক খুনের তকমা পেয়ে যায়। পুলিশ গ্রেফতার করে শশাঙ্ক, তাঁর ভাইপো অরুণ বিশ্বাস এবং বগুলা-১ পঞ্চায়েতের প্রধান বিমল বিশ্বাস-সহ ১১ জনকে। এক খুনেই প্রায় বিরোধীশূন্য হয়ে যায় হাঁসখালি। তবে, দুলাল-খুন নিয়ে এ দিন শঙ্কর বিশ্বাস কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
রাজনৈতিক খুন কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে থেমে থাকেনি। দু’মাসের মধ্যে ফের খুন। লোকসভা ভোটের মুখে ভায়না স্টেশনে তিন জনকে গুলি করে মারা হয়। তাঁদের এক জন কৃষ্ণ বিশ্বাস। পুলিশের এক প্রাক্তন কর্তা বলেন, ‘‘সে সময়ে বলা হত খোলাখুলি, কৃষ্ণ কারবারে বাধা!’’
ওই ঘটনার পরে আর সিপিএম দুলালকে আশ্রয় দেয়নি। পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে। সাড়ে চার বছর জেলে কাটিয়ে যখন জামিনে মুক্তি মেলে, তত দিনে রাজ্য রাজনীতিতে বদলের ঝড়। মাথা ঠান্ডা রেখে বছর দুয়েক কাটানোর পরে ২০১২ সালে সটান তৃণমূলের অন্দরে ঢুকে পড়েন তিনি। ইতিমধ্যে ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদল ঘটে গিয়েছে। ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়ছে সিপিএম। দুলাল দল বদলেও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি প্রায় অক্ষুণ্ণ রাখেন। অচিরে তৎকালীন জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের ‘কাছের লোক’ও হয়ে ওঠেন তিনি। গৌরীশঙ্কর এ দিন বলেন, ‘‘যাদের অবদানে তৃণমূল শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়েছিল, দলের তেমন এক সৈনিক চলে গেল!’’