সত্যেন মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
কৃষ্ণনগর ফোয়ারা মোড়ে রংচটা নীলচে দেওয়ালের স্টুডিয়োয় পুরনো ফোল্ডিং চেয়ারে বসে ছিপছিপে বংশী মোদক বলেন, ‘‘১৯৫৫ সালে এখানে ফোয়ারা ছিল না। ছিল মস্ত বট গাছ। আর ঘোড়ার আস্তাবল।’’ ঘরটায় আগে ছিল পেট্রল বিক্রির দোকান। বংশীর মামা সত্যেন মণ্ডল সেখানে খোলেন ‘আলেখ্য’ স্টুডিয়ো। বংশীর বয়স তখন বড়জোর দশ। বেশ মনে আছে, কয়েক বছর পরে এই স্টুডিয়োয় এক দিন হাজির সত্যজিৎ রায়। তখন মহেশগঞ্জে ‘অপুর সংসার’ ছবির শুটিং চলছে। তার জন্যই সত্যজিৎ স্টুডিয়োর ডার্করুম ব্যবহার করতে চান। সত্যেন কি রাজি না হয়ে পারেন? বরং তাঁর ডবল লেন্স রিফ্লেক্স রোলিকর্ড ক্যামেরা নিয়ে মহেশগঞ্জে ছোটেন শুটিংয়ের ছবি তুলতে। পরে সত্যজিতের ‘দেবী’ আর ‘জলসাঘর’ ছবিতেও স্টিল ফটোগ্রাফারের কাজ করেছেন সত্যেন।
সত্যেন মণ্ডলের জন্ম ১৯৩৫ সালে ১৪ মার্চ। বড়মামা বৈদ্যনাথ দাক্ষীর ফটোগ্রাফির নেশা। সেই নেশা তাঁকেও ধরে গেল। সবে দেশভাগ হয়েছে। যে মুসলিমের বাংলাদেশ চলে যাচ্ছেন, গ্রামে-গ্রামে ঘুরে তাঁদের পরিবারের মহিলাদের পাসপোর্ট ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরনো সত্যেন। এ ভাবেই কখন নেশা হয়ে গেল পেশা।
তার পর কত রকম ছবি তুলে গিয়েছেন জীবনভর। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কুষ্টিয়া, যশোহর, নোয়াখালি চলে গিয়েছেন ছবিতে ইতিহাস ধরে রাখতে। ফিরে এসে ছবি প্রিন্ট করে কয়েকটা ছুটতেন কৃষ্ণনগর স্টেশনে, ট্রেনের চালকের হাত দিয়ে কলকাতায় খবরের কাগজের অফিসে পাঠানোর জন্য। বাকি সব ছবি প্রিন্ট করে দিতেন আর তারপর জেলা প্রশাসনকে। ’৬৬ খাদ্য আন্দোলনের বহু মুহূর্ত ধরা আছে তাঁর ক্যামেরায়।
‘অপুর সংসার’ ছবির স্টিল।
এক সময়ে আনন্দবাজার, যুগান্তর-সহ অনেকগুলি সংবাদপত্রে ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফারের কাজ করেছেন সত্যেন। বার্লিন থেকে আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন। কৃষ্ণনগর ক্যামেরা ক্লাব ও সিনে ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠতা সদস্য ছিলেন তিনি। স্ত্রী জোৎস্না বলেন, ‘‘স্টুডিয়ো আর ছবিই ছিল জীবন। দেখা হতো দু’বার খাবার সময়ে। আর পুজোর সময়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন।’’
মৃৎশিল্পের রাজধানী, কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণী প্রিয় ছিল সত্যেনের। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী বীরেন পাল ছিলেন প্রিয় বন্ধু। তাঁর ছেলে, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী সুবীর বলেন, ‘‘আমরা ওঁকে ছবিকাকা বলে ডাকতাম। উনি আমাদের কাজ করার নানা রকম ছবি তুলে রাখতেন।’’ ঘূর্ণী নিয়ে একটা তথ্যসমৃদ্ধ ছবির বই করারও ইচ্ছে ছিল সত্যেনের। মেয়ে সুপ্রমার আক্ষেপ, ‘‘ছবিগুলো সেই ভাবেই পড়ে আছে”।
আজীবন সাদা কালো ছবিকেই ভালবেসে এসেছেন সত্যেন। ১২০ সাদা কালো ফিল্মে তাঁকে রাজার আসনে বসান অনেক ফটোগ্রাফারই। রঙিন ছবি কোনও দিন তাঁকে টানেনি। বংশী বলেন, ‘‘মামা বলতেন, সাদা-কালো ছবিতেই ফটোগ্রাফারের জাত প্রকাশ পায়। তবে চার্চের ফাদারদের দেওয়া কিছু কালার স্লাইডেও ছবি তুলেছেন।’’
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি দুপুরে সাদা আলো নিভে চিরতরে কালো পর্দা নেমে আসে। থেকে যায় শুধু ছবি। বংশীর আক্ষেপ, ‘‘অনেক ছবি ঘুণ ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না।’’ চোখের জল ফেলে সুপ্রমা বলেন, ‘‘বাবা বলতেন, আমি যখন রইব না, আমার ছবি কইবে কথা। বাবার সংহশালা করেই বাঁচাব তাঁর স্মৃতি।’’