প্রতীকী ছবি।
কথায় বলে, অন্নচিন্তা চমৎকারা! সেই কথা আর নেহাত কথার কথা রইল না। ডিজেল, পেট্রল, রান্নার গ্যাস, ভোজ্য তেলের পর বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় নতুন সংযোজন বাঙালির প্রধান খাদ্য চাল।
সাধারণ মানুষের কপালে ভাঁজ ফেলে মাত্র এক মাসের মধ্যে চালের দাম কেজি প্রতি ৫-১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, চালের দামের এই বাড়বাড়ন্ত এখন চলতেই থাকবে। প্রতিদিনের খাওয়ার সাধারণ চাল হোক বা ভোজের পাতের পোলাও-বিরিয়ানির সুগন্ধি চাল। সম্পন্ন গৃহস্থের সরু বাঁশকাঠি কিংবা নিম্নবিত্তের মোটা লাল স্বর্ণ।
এ হেন চালচিত্রে মাসকাবারি হিসাব মেলাতে নাভিশ্বাস জনতার। চাল ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, রাজ্যে বৈশাখের মাঝামাঝি নাগাদ নতুন সরু (বোরো) চাল বাজারে আসতে শুরু করে। অন্য বছরের সঙ্গে এ বারের ফারাক, বাজারে আসার মাসখানেক পর থেকেই দাম বাড়তে শুরু করে নতুন চালের। চালের খুচরো বিক্রেতা রীতিময় সাহার মতে এটা স্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, “বরং নতুন চাল ওঠার পর দাম কিছু দিন থিতু থাকে। গত বছর গোটা মরসুম ধরে প্রতি কেজি কমবেশি ৩৮-৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া মিনিকেট এ বার জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকেই চড়তে শুরু করেছিল। ফলে আষাঢ়েই খুচরো বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম পৌঁছে যায় ৪২-৪৩ টাকায়। এর পর গত এক মাসে নিয়মিত সেই দাম কেজি প্রতি বাড়তে বাড়তে এখন ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।”
একই সুরে নদিয়ায় চালের বড় পাইকার মহাদেব সাহারও। তিনি বলেনস “মরসুমের শুরুতে এ বার যে চাল ১১৫০-১২০০ টাকা (৬০ কেজির বস্তা) কিনেছিলাম, এখন তা ১৭০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কত দিন এই দাম থাকবে তা নিশ্চিত নই।” আগামী দিনে চালের দাম আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনার কথা জানাচ্ছেন সব ধরনের ব্যবসায়ীরাই।
রবিবার ফের একপ্রস্ত দাম বেড়ে এই সময়ে নদিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে মিনিকেট চাল প্রতি কেজি কমবেশি ৪৮-৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি ‘গরিবের চাল’ বলে পরিচিত ২৭-২৮ টাকা কেজি দরের মোটা লাল স্বর্ণের দর ৩২ টাকা কেজির আশপাশে পৌঁছে গিয়েছে। উল্টো দিকে, ১০০-১০৫ টাকার বাসমতীর কেজি ১১৫- ১২০ টাকা প্রায়।
আচমকা চাল এমন অগ্নিমূল্য কেন? প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যায় ধানের বিপুল ক্ষতি, জিএসটি, চালের ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির ঢুকে পড়া তার অন্যতম কারণ। তবে চালের দামের এই ঊর্ধ্বগতিকে ‘হঠাৎ বৃদ্ধি’ বলতে রাজি নন ছোট-বড় পাইকার থেকে কুঠিয়াল কেউই। তাঁদের অনেকেরই দাবি, এই বৃদ্ধি পরিকল্পিত।
চাকদহ কেন্দ্রীয় ধান্য-চাউল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জন সাহা বলেন, “গত বছর থেকেই এই ব্যাপার শুরু হয়েছে। চালের বাজারে বড় পুঁজি নিয়ে নামী-দামি শিল্পগোষ্ঠী ঢুকে পড়ছে। তারা সরাসরি চাষির কাছ থেকে ধান কিনে নিচ্ছে। এরপর নিজেদের মিলে সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে নানা ভাবে বিপণন করছে। ছোট-বড় নানা ওজনের প্যাকেট করে যেমন শপিং মলে বিক্রি করছে, তেমনই সাধারণ বাজারের চালের নিয়ন্ত্রণও তারাই বকলমে করছে। চালের প্যাকেটে জিএসটি-ও দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।”
এর সঙ্গে আছে বন্যা-সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জেলার ধান-চাল ব্যবসায়ীদের সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক মহাদেব সাহা বলেন, “গত মরসুমে বোরো ধান কাটার সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কমবেশি ৬০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার মারাত্মক প্রভাব এখন বোঝা যাচ্ছে। এ বার আমনের অবস্থাও বেশ খারাপ। জলের অভাবে বহু জায়গায় সম্পূর্ণ জমিতে ধান বুনতে পারেননি চাষিরা। অন্যান্য ধান উৎপাদক রাজ্যগুলিতে বন্যার কারণে ধান নষ্ট হওয়ায় বিপুল পরিমাণে উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সবটা মিলিয়ে বাড়ছে চালের দাম।”
(চলবে)