পকেটে: চলছে ম্যাচ। নিজস্ব চিত্র
বুকপকেটের স্ট্রাইকার হাতে উঠে এলেই চুপ মেরে যায় ক্লাবের গুলতানি।
কয়েক জোড়া চোখ তখন আঠার মতো লেপ্টে থাকে ওঁদের আঙুল আর বোরিক ছড়ানো ক্যারাম বোর্ডে। নিখুঁত ক্ষিপ্রতায় পকেটে পড়তে থাকে একের পর এক ঘুঁটি। কখনও সেকেন্ড, কখনও থার্ড, কখনও আবার বেস কিংবা ইঞ্চি-র অনায়াস কেরামতিতে হাততালির ঝড় ওঠে গুমটি ক্লাবঘরে। তবে শুধু শুকনো হাততালিতেই সব শেষ নয়। খেলা সাঙ্গ হওয়ার পরে খাতিরেও কোনও খামতি থাকে না।
পাশ থেকে কেউ হাঁক দেন, ‘ওরে কে আছিস, দু’টো কড়া চা পাঠিয়ে দে।’
কেউ আবার বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘এই যে গুরু, না ভাঙা সিগারেটের প্যাকেটটাই আজ তোমাদের। উফ, কী খেলাটাই না দেখালে!’
কেউ আবার ভারী গলায় বলেন, ‘এমন ভাব করছ যেন ওরা এই প্রথম এমন খেলল! ক্যারামটাকে যে এমন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা তো ওরা কবেই প্রমাণ করে দিয়েছে।’
ক্যারামে ঝড় তুলে চা-সিগারেট-অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে বাড়ি পৌঁছনোর পরে করিমপুরের নিবু ঘোষ কিংবা মানিক দাসকে সামলাতে হয় আর একটা ঝড়!
—‘বলি, এ ভাবে আর কদ্দিন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবি রে বাবু? কাজকর্ম কিছু কর।’
—‘ক্যারামকেই তো বিয়ে করলে পারতে? আমাকে নিয়ে আসার কী দরকার ছিল?’
—‘ওই যে, হাতে-মুখে পাউডার মেখে বাবু ফিরলেন? এমন সোনার টুকরো ছেলের জন্য মাছের মুড়োটা তুলে রেখেছ তো?’
অথচ এই বকুনিনামচা গত দু’দিন ধরে বিলকুল হাওয়া। ছেলে রাতভর বাড়ির বাইরে থাকলেও কেউ রাগ করেননি। বরং ফোন করে জানতে চেয়েছেন, ‘‘দাঁতে কিছু কেটেছো? নাকি খালি পেটেই বিপ্লব হচ্ছে? সকালের বাজার হয়নি। তবুও কেউ রা কাড়েননি। বরং উৎসাহী হয়েই জানতে চেয়েছেন, ‘‘কী গো, এত হইহই করে প্র্যাকটিস তো করলে। জিতল কারা?’’
করিমপুর শনিবার সকাল থেকে রবিবার বিকেল পর্যন্ত মেতেছিল সারা বাংলা ক্যারাম প্রতিযোগিতা নিয়ে। সীমান্ত ঘেঁষা এই জনপদে তেমন কোনও বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। তাই টি-টোয়েন্টি, ফুটবল তো বটেই, ক্যারামের মতো ইনডোর গেম নিয়েও এলাকার মানুষের উৎসাহের অন্ত থাকে না।
স্থানীয় বেশ কয়েকটি ক্লাব, দোকানের সামনে ফাঁকা জায়গায় প্রায় সারা বছর ধরেই চলে ক্যারাম। বছর পাঁচেক ধরে রাজ্যের বেশ কয়েকটি এলাকার দলকে নিয়ে করিমপুরেই এই প্রতিযোগিতায় আয়োজন করছে করিমপুর লোকাল ক্যারাম কমিটি।
ওই কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা নিবু ঘোষ জানান, এ বারের প্রতিযোগিতার জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল স্থানীয় একটি লজ। ৬৪টি দলের খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানেই। চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স ট্রফির পাশাপাশি পুরস্কার ছিল নগদ টাকাও।
রবিবার খেলা শেষে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ধুলিয়ানের অমিত বিশ্বাস ও ডোমকলের নারায়ণ মাহেশ্বরী। রানার্স হয়েছেন ভগবানগোলার কালু শেখ ও পূর্ব মেদিনীপুরের অরিজিৎ চৌধুরী। আর করিমপুরের যে দু’জন খেলোয়াড়ের দিকে এলাকার সকলে তাকিয়েছিলেন আনন্দপল্লির সেই নিবু ঘোষ ও পাট্টাবুকার মানিক দাস থমকে গিয়েছেন সেমিফাইনালে।
খেলায় শেষে ওঁরা দু’জনেই বলছেন, ‘‘ওঁরা আমাদের থেকে অনেক ভাল খেলেছেন।’’ নিবু-মানিকের ফ্যানেরা অবশ্য হতাশ হলেও হাল ছাড়তে রাজি নন। তাঁদের কথায়, ‘‘ভাগ্য বলেও তো একটা জিনিস থাকে, নাকি! পরের বার নিবু-মানিকরাই দেখবেন খেল দেখাবে।’’
নিবুর এমন ক্যারাম-কীর্তি সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখছেন বাবা ননীগোপালবাবু। বাজারে মিষ্টির দোকান সামলানোর ফাঁকে বলছেন, ‘‘চ্যাম্পিয়ন হলে এ বারের মতো বাঁচতাম।
কিন্তু সেমিফাইনালে আটকে গিয়ে খিদে তো আরও বেড়ে গেল। এখন আরও বেশি করে ক্যারাম পিটবে।’’
আর মানিকের স্ত্রী রাধা দাস হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘আমি আর বকাঝকা করি না। কারণ জানি, ক্যারামটা ও কোনও দিনই ছাড়বে না।’’ সম্প্রতি ডোমকলেও হয়ে গিয়েছে ক্যারাম প্রতিযোগিতা। সেখানে নারায়ণের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন এলাকার লোকজন। তবে শেষপর্যন্ত ভাল জুটির অভাবে নারায়ণ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। এ বারে ডোমকল উচ্ছ্বসিত। কারণ তাদের ‘হিরো’ নারায়ণ এলাকার মান রেখেছেন। ডোমকলের চাওয়ালা থেকে ক্লাবের লোকজন, সকলেরই এক কথা, ‘‘জানতাম, করিমপুরে নারায়ণ চ্যাম্পিয়ন হবে। ও তো ঘুমের মধ্যেও ক্যারাম খেলে গো।’’