স্বপ্নের উড়ানে ওঁরাই পাইলট

সিনেমার বাইরেও আছেন খিদ্দা কিংবা নিকুম্ভ স্যার। গলার শিরা ফুলিয়ে কেউ চিৎকার করেন, ‘‘ফাইট কোনি ফাইট।’’ কেউ আবার হারতে হারতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। ইশান্ত অবস্তির মতো। নিকুম্ভ স্যারের হাত ধরে তাক লাগিয়ে দেয় তামাম দুনিয়াকে। ৫ সেপ্টেম্বর, এমনই কয়েকজন লড়াকু শিক্ষকের খোঁজ পেল আনন্দবাজারসিনেমার বাইরেও আছেন খিদ্দা কিংবা নিকুম্ভ স্যার। গলার শিরা ফুলিয়ে কেউ চিৎকার করেন, ‘‘ফাইট কোনি ফাইট।’’ কেউ আবার হারতে হারতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। ইশান্ত অবস্তির মতো। নিকুম্ভ স্যারের হাত ধরে তাক লাগিয়ে দেয় তামাম দুনিয়াকে। ৫ সেপ্টেম্বর, এমনই কয়েকজন লড়াকু শিক্ষকের খোঁজ পেল আনন্দবাজার

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৪১
Share:

স্বপ্ন তো অনেকেই দেখেন। কিন্তু যৌথ-স্বপ্ন?

Advertisement

যে স্বপ্ন পূরণ হলে একা তিনি নন, মুক্তি পাবেন তাঁর মতো অসংখ্য মানুষ? খাদেজা বানু পেরেছেন।

খেলা মানে ছেলেখেলা নয়। দরকার অধ্যাবসায়, একাগ্রতা আর জেদ। তাই নির্মলকুমার দাস ঘুমের মধ্যেও চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ওরে হতভাগা, বলটা পাস কর।’’

Advertisement

চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে এসে তৌফিকুল ইসলাম আবার ছাত্রদের বলে বসেন, ‘‘হ্যাঁরে, একটা সিনেমা বানাবি?’’ পরের দিন থেকে স্কুলছুট শূন্য। পড়ুয়াদের তৈরি সেই সিনেমা পুরষ্কৃতও হয়েছে।

এবং খাদিজা

তালাক! তালাক! তিন তালাক! স্বামী বলে দিয়েছিলেন মুখের উপরে। কোলে বছর আড়াইয়ের শিশুপুত্র। তারপর? যুদ্ধটা শুরু হল তারপরেই।

ছয় বছরের দাম্পত্যে ইতি টেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হয় সাগরদিঘির বিলকিস রোজিনা আখতারাকে। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাবা-মায়ের সংসারে ছেলেকে নিয়ে তিনি তখন বাড়তি বোঝা। তাঁর সামনে তখন একটাই পথ—আত্মহত্যা। এমন সময় তিনি শোনেন তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী পরিত্যক্ত, দুঃস্থ মহিলাদের পাশে দাঁড়ানো ‘রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি’র কথা। সেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক খাদিজা বানুর হাত ধরে বিলকিস এখন স্বনির্ভর হয়েছেন। অসমে হাজার সতেরো টাকার মাস মাইনের চাকরি। বিলকিস বলছেন, ‘‘খাদিজা বানু না থাকলে আমার যে কী হত, কে জানে! আমি নিজে যে কিছু করতে পারি সেই স্বপ্ন আমাকে দেখিয়েছিলেন খাদিজা। বলেছিলেন, দুঃখ করবি না। জানবি রাতের পরেই সকাল আসে।’’

বছর তিরিশের জাহানারা বেগমের স্বামী তখন শয্যাশায়ী। সংসার প্রতিপালনের দায় ঘাড়ে এসে পড়ে তাঁর উপরে। কী হবে? মুশকিল আসান করে দিলেন সেই খাদিজাই। দুঃস্থ মহিলাদের স্বনির্ভর করতে ভগবানগোলায় তখন চলেছে টেলারিং প্রশিক্ষণ শিবির। জাহানারা বলেন, ‘‘সেখানে প্রশিক্ষণের পরে আমি এখন বড় দর্জি দোকানের মালিক। বানুদির জন্যই আজ আমি সফল হয়েছি।’’ তবে থেমে যাননি তিনি। প্রতি রবিবার বহরমপুরে ‘রোকেয়া ভবন’-এ গিয়ে জাহানারা অন্য নিরুপায় মহিলাদের বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দেন।

ষাটোর্ধ্ব খাদিজা বানু বলছেন, ‘‘২০০৬ সালে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে পুণেতে গাঁধী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ও মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদে কস্তুরবা গাঁধী মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত দু’টি সেমিনারে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত ছিলাম। সেখানে হতদরিদ্র, অসহায় মহিলাদের দুঃসহ কান্না দেখে মন বলল, এঁদের জন্যই কাজ করতে হবে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি।’’

নারান স্যার

ঘুমের মধ্যেও তিনি চিৎকার করেন, “দিলি তো বলটা নষ্ট করে।”

আর জেগে থাকলে? তখনও নিস্তার নেই। মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ কিলবিল করে ফুটবল ভূত। স্ত্রী স্নিগ্ধা দাস হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘মানুষটা এমনই। মন সারাক্ষণ মাঠে। বিয়ের পর থেকেই একই রকম দেখে আসছি।”

তিনি নির্মল কুমার দাস। কৃষ্ণনগর চেনে নারান স্যার বলে। বছরের পর বছর ধরে কৃষ্ণনগরের পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি চালিয়ে আসছেন ফুটবল কোচিং ক্যাম্প। প্রশিক্ষণের পরে ভেজানো ছোলা থেকে শুরু করে জার্সি, বুট সবেরই জোগান দেন তিনিই। খিদে পেলে? ছাত্ররা বলে, “মুখের দিকে তাকালেই স্যার ঠিক বুঝতে পারেন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কে খেয়ে আসেনি। কার জ্বরের ওষুধ লাগবে। মুহূর্তের মধ্যে হাজির বিস্কুটের প্যাকেট, প্যারাসিটামল।”

নিজে কোনও দিন বড় খেলোয়াড় ছিলেন না। প্রথাগত প্রশিক্ষণও নেই। কিন্তু তাঁর হাত ধরেই উঠে এসেছে একাধিক খেলোয়াড়। যাদের অনেকেই সাই থেকে শুরু করে কলকাতার বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। নারান স্যারের বয়স প্রায় ৭০ বছর। পেশায় বস্ত্র ব্যবসায়ী। সুগারের সমস্যায় শরীর এখন অনেকটাই দুর্বল। কিন্তু মনের উপরে তার কোন প্রভাব পড়েনি। এখনও মাঠে নামলেই সেই হাঁকডাক।

প্রথমে রবীন্দ্রজয়ন্তী ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কোচিং-এর হাতেখড়ি সেখান থেকেই। কিন্তু জীবিকার টানে তাঁকে চলে যেতে হয় আমদাবাদে। ফিরে আসেন ১৯৯৮ সালে। সেই বছরেই তৈরি হল মানা গুঁই স্মৃতি ক্যাম্প। হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে জজ কোর্ট মাঠে তাঁর ক্যাম্প শুরু হলেও এখন প্রায় ৪০ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে বছর দুয়়েক আগে কালীনগরে একটি বড় মাঠে পেয়ে যাওয়ায় সেখানেই চলছে তাঁর ক্যাম্প। প্রতিবছরের মতো এ বারও শিক্ষক দিবসে তাঁর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ছাত্ররা। মাঠেই কাটা হল কেক। টিফিনের পয়সা জমিয়ে স্যারের জন্য উপহার নিয়ে এসেছিল ছাত্রেরা। তাদের কথায়, “শুধু খেলার মাঠেই নয়, সব ক্ষেত্রেই আমরা স্যারকে পাশে পাই।” আর এ সব শুনে লাজুক হাসছেন নারান স্যার, ‘‘ওদের কথায় কান দেবেন না। ওরা বড্ড বাড়িয়ে বলে।”

তৌফিকের তোফা

সিনেমা? কারা বানাবে, ছাত্ররা?

কত কথায় তখন হাওয়ায় ভেসেছিল। কান দেননি তিনি। কান দিতে নিষেধ করেছিলেন পড়ুয়াদেরও।

তারপর তো হাততালি, অভিনন্দন আর প্রশংসা।

নবগ্রামের ইন্দ্রাণী হাসনামায়ানি হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক তৌফিকুল ইসলাম বলছেন, ‘‘আরে না না, গোটা কৃতিত্বই আমার ছাত্র ও সহকর্মীদের। আমি শুধু ওদের পাশে থেকেছি মাত্র।’’ নবগ্রাম স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ক্যামেরা চালানো তো দূরের কথা, অনেকে তখনও মুভি ক্যামেরাই চোখে দেখেনি। বহরমপুরের বাসিন্দা তৌফিকুল তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি হ্যান্ডিক্যাম জোগাড় করেন। তারপর পড়ুয়াদের শিখিয়ে দেন কী ভাবে ক্যামেরায় ছবি তুলতে হয়।

২০১১ সালে পড়ুয়ারা প্রথম সিনেমা বানায়—‘ইসকুল’। ১০ মিনিটের ওই তথ্যচিত্র পুরষ্কৃতও হয়। পরে তৌফিকের উদ্যোগে পড়ুয়ারা ‘সবুজালয়’ নামে আরও একটি ছবি করে। কলকাতা আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মাই ক্যামেরা মাই ওয়ার্ল্ড’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পায়। ২০১৫ সালে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত ১৯ তম শিশু চলচ্চিত্র উৎসবেও ওই স্কুলের অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির পাঁচ পড়ুয়া যোগ দিয়েছিল।

খিদ্দা, নিকুম্ভ স্যারেরা আশপাশেই আছেন। শুধু স্বপ্ন দেখার সাহস চাই।

তথ্য: অনল আবেদিন, সুস্মিত হালদার ও শুভাশিস সৈয়দ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement