ফাইল চিত্র।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২৫ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য শৌচাগার রয়েছে ১১টি। গত জুন মাসে নির্মল বিদ্যালয় হিসেবে সেরার পুরস্কারও জিতে নিয়েছে সুতি ১ ব্লকের আলুয়ানি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। আলুয়ানির আড়াইশো পরিবারের মধ্যে ১৪২টি পরিবারে আজও কোনও শৌচাগার নেই। ফলে ভরসা সেই মাঠ!
জেলাকে নির্মল করতে উঠেপড়ে লেগেছে প্রশাসন। অথচ কাকভোরেই মাঠে নামছে গ্রামের অর্ধেকের বেশি লোক। ‘নির্মল মিশন বাংলা’ তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে সুতির আলুয়ানিতে। পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসনের কর্তারাও জানেন শৌচাগার নিয়ে আলুয়ানির এমন দশার কথা। কিন্তু তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, শৌচাগারমুখী করতে তাঁদের আর কিছু করার নেই!
গ্রামে ঢুকতেই অনিমা সরকারের বাড়ি। বাড়িতে পাঁচ জন সদস্য। শৌচাগার করার জায়গাও রয়েছে বাড়িতে। কিন্তু শৌচাগার নেই। তাই ভরসা এখন মাঠঘাটই। তিনি বলছেন “শৌচাগার গড়তে হাজার দশেক টাকা খরচ। এত টাকা পাব কোথায়?”
পেশায় দিনমজুর দীপক সরকারও বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েত সদস্যকে বার বার বলেছি। কিন্তু সরকারি প্রকল্পে শৌচাগারের অনুদান মেলেনি।” অময় সরকারের বাড়িতে লোকসংখ্যা ১০ জন। তিনি বলছেন, “সরকারি আর্থিক সাহায্যে শৌচাগারের কথা গ্রামে এসে কেউ কখনও বলেইনি। একটা শৌচাগার করতে নাকি ১২ হাজার টাকা লাগবে। গ্রামের বেশির ভাগই দিনমজুর। তাদের সে সামর্থ্য নেই। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় কমিউনিটি টয়লেটের জন্য পঞ্চায়েতে বলেছিলাম। সেটাও হল না। নিরুপায় হয়েই লোকজন মাঠে ছুটছেন।”
সঞ্জিত সরকার বলছেন, “এক সঙ্গে এত টাকা দিতে পারব না। বলেছিলাম, কিস্তিতে দেব। ব্লক অফিসের লোকজন রাজি হয়নি।” চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া সিদ্ধার্থ সরকারের কথায়, “আমাদের স্কুলে অনেক শৌচাগার। মাঠে যেতে লজ্জা লাগে। তাই আমি স্কুলের শৌচাগারেই যাই। বাবাকে বলেছি, বাড়িতেও একটি শৌচাগার গড়তে। কিন্তু বাবা বলেছে, ‘টাকা নেই’।” প্রথম শ্রেণির পড়ুয়া অংশু সরকারের বাড়িতেও একই দশা। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘আমিও বাবাকে কত বার বলেছি, বাড়িতে শৌচাগার তৈরি করতে।” পাশে দাঁড়িয়ে বাবা খোকন সরকার ছেলের কথা শুনে লজ্জায় মুখ নামান।
গ্রামে ১৪টি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী পদ্ম সরকার বলছেন, “বাড়ি, বাড়ি ঘুরে বহু অনুরোধ করলেও ওঁদের সামর্থ্যে কুলোয়নি। কয়েক মাস আগে সমীক্ষা করে দেখেছি, গ্রামের ১৪২টি বাড়িতে এখনও শৌচাগার নেই। তাই স্কুল নির্মল পুরস্কার পেলেও গ্রামের বহু লোকজন সেই আগের মতোই এখনও ছুটছেন মাঠ-ঘাটে।”
স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের লোটন সরকারও মানছেন, আলুয়ানি নির্মল মিশনে বেশ পিছিয়ে। তিনি বলছেন, “আড়াইশো পরিবারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাড়িতে শৌচাগার নেই। এক সঙ্গে দু’-চার হাজার টাকা জোগাড় করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক প্রশাসন মিলে যৌথ ভাবে ফান্ড সংগ্রহ করে কিছু উপকরণ কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে কথা কানে তোলেননি কেউ। এখন মাঠমুখী জনস্রোতকে তো আর মারধর করে থামাতে পারব না।”
সুতি ১ ব্লকে শৌচাগার তৈরির প্রকল্পের নজরদারির দায়িত্ব যুগ্ম বিডিও সুদীপ বসুর। তিনিও জানেন আলুয়ানির নির্মল বাংলা মিশনের বেহাল অবস্থার কথা। তিনি গ্রামে গিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের আর কিছু করার নেই। ওই প্রকল্পে বরাদ্দ শেষ। এখন নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে শৌচাগার। কী ভাবে করবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার।”
প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক অতীশ মণ্ডল অবশ্য আশা ছাড়েননি। তিনি বলছেন, ‘‘এলাকায় তো বিড়ি-সহ নানা শিল্প সংস্থার বিত্তশালী লোকজন থাকেন। এ ব্যাপারে ১০টি করে পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে আলুয়ানিকে নির্মল করতে তাঁরাও তো এগিয়ে আসতে পারেন।”