ফাইল চিত্র।
রাস হবে, কিন্তু আড়ং নয়! মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা অথচ সামনে বাজছে না ইংলিশ ব্যান্ড, ব্যাঞ্জো-তাসা, নিদেন পক্ষে ঢোল-সানাই! নবদ্বীপের রাসের অতি বড় সমালোচকও কখনও এমনটা কল্পনা করেননি। কিন্তু করোনা আবহে এ সবই সত্যি হতে চলেছে নবদ্বীপের আসন্ন রাসোৎসবে। অতিমারির কালে আমূল বদলে যেতে বসেছে নবদ্বীপের চেনা রাস। কোভিড সংক্রমণ রুখতে দুর্গাপুজোর পর নবদ্বীপের রাসও কঠোর প্রশাসনিক নজরদারিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নবদ্বীপের কেন্দ্রীয় রাস উৎসব কমিটির ডাকা জরুরি বৈঠকে তেমনটাই জানালেন প্রশাসনের কর্তারা।
করোনা পরিস্থিতিতে এবার দুর্গাপুজো ঘিরে নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। বাঙালির প্রাণের উৎসব বাঁধা পড়েছিল কঠোর নিয়মের নিগড়ে। মানুষ দেখেছেন অন্য রকম পুজো। আদালত নির্দেশিত সেই পথ অনুসরণ করেই নবদ্বীপের রাসোৎসব পরিচালিত হতে চলেছে অন্য রকম পথে। দুর্গাপুজো মিটতেই নবদ্বীপের রাসের ঢাকে কাঠি পড়ে যায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিমার পাটপুজোর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে যায় রাসের প্রক্রিয়া। ঠিক তার আগের দিন জরুরি ভিত্তিতে সমস্ত রাস বারোয়ারি এবং প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন নবদ্বীপের কেন্দ্রীয় রাস উৎসব কমিটি। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে নবদ্বীপের রাসের অনেক কিছুই চূড়ান্ত হয়ে যায়। যাতে আয়োজকেরা পরে বলতে না পারেন যে, আমাদের প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছে, তাই তড়িঘড়ি এই মিটিংয়ের ব্যবস্থা করি আমরা। এ বার যা পরিস্থিতি তাতে রাসের উদযাপন লাগামছাড়া হলে গোটা শহরের জন্য বড় ধরনের বিপদ আসতে পারে। তাই এই সতর্কতা। হয়ত নবীন প্রজন্মের আয়োজকেরা ক্ষুণ্ণ হবেন। কিন্তু সকলের কথা ভেবে এ ছাড়া উপায় ছিল না।”
নবদ্বীপ রবীন্দ্র সংস্কৃতি মঞ্চে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে রাসের উদ্যোক্তা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নবদ্বীপের বিধায়ক, পুরপ্রশাসক, বিডিও-সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক আধিকারিকেরা। বৈঠকে পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১) এবারের রাসে ঢাক ছাড়া কোনও বাজনা বাজানো যাবে না। প্রতিমা পিছু ঢাকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ছ’টি। ২) রাসের আড়ং সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। প্রতিমা মণ্ডপ থেকে সরাসরি বিসর্জনের ঘাটে চলে যাবে। প্রতিমা বিসর্জনের দিনক্ষণ পুলিশ জানিয়ে দেবে। ৩) রাসের দিন সকালে নবমীর শোভাযাত্রা এ বার সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। পোড়মাতলায় নবমীর পুজো দেওয়ার জন্য একটি বারোয়ারি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন পর্যন্ত যেতে পারবেন। সঙ্গে কোনও বাজনা নেওয়া যাবে না। ৪) কয়েক বছর ধরে পুরসভার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত রাস কার্নিভাল এবার বন্ধ থাকছে।
বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা বলেন, “নবদ্বীপের অন্যতম প্রধান উৎসব রাস। কিন্তু এ বারের অবস্থা ভিন্ন রকম। তাই প্রশাসন যে ভাবে বলবে, সে ভাবেই রাস পালন করতে হবে। কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।” ঐতিহ্যের রাস উৎসবে এত কাটছাঁট শুনে বেশ কয়েকটি পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা সভা ছেড়ে চলে যান। নবদ্বীপের পুর প্রশাসক পর্ষদের চেয়ারপার্সন বিমানকৃষ্ণ সাহা এই প্রসঙ্গে বলেন, “পুলিশ প্রশাসনকে ভুল বুঝে সভা থেকে চলে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, এবারের রাস অন্য রকম। চৈতন্যধাম নবদ্বীপ সারা বিশ্বের প্রণম্য স্থান। সুতরাং এমন কিছু করা যাবে না, যাতে লোকে ছি ছি করে। রাসকে অন্য ভাবে সুন্দর করে তুলতে হবে।”
এ দিনের সভার সুর বেঁধে দেন নবদ্বীপের আইসি কল্লোলকুমার ঘোষ। তিনি একের পর এক ঘোষণা করেন কী কী করা যাবে, আর কী কী করা যাবে না। বাজনা বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নবদ্বীপে রাসের বেশির ভাগ বাজনাই আসে কলকাতা-সহ ভিন জেলা থেকে। এবারে কোভিড সংক্রমণের পরিস্থিতিতে সেই বাজনাওয়ালারা যাতে শহরের জন্য সংক্রমণের বাহক না হয়ে ওঠেন, সেই জন্য এই পদক্ষেপ।’’সব মিলিয়ে এক ব্যতিক্রমী রাস দেখতে চলেছে নবদ্বীপ।