কাটমানি রুখতে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের নয়া উদ্যোগ— নিজের ঘর নিজেই গড়ুন!
নিজের বাড়িটা নিজেই গড়ুন— গ্রামের এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় টলমলে রিকশা, ধরা ধরা গলায় প্রচার করছেন জেলা প্রশাসনের কর্মী। গাঁ-গঞ্জের মোড়ে ভিড় করা মানুষজনের সামনে রিকশা থেকে নেমে একটা আড়মোড়া ভেঙে ভদ্রলোক বলছেন, ‘‘মন দিয়ে শুনুন, আপনার ঘর কেউ পাইয়ে দিচ্ছে না কিন্তু। সরকারি অনুদান এসেছে সরাসরি আপনারই নামে। সে টাকায় কেউ ভাগ বসাতে এলে সটান না
বলে দেবেন।’’
গত কয়েক মাস ধরে গ্রাম বাংলার চালু লব্জ ‘কাটমানি’ শব্দটা সযত্নে এড়িয়ে বকলমে তিনি বোঝাতে চাইছেন, ‘বাংলা আবাস যোজনা’র টাকায় কোনও ভাগ নেই, নেই কোনও নেতা-কর্মীর বদান্যতা। ঘর পাইয়ে দেওয়ার অছিলায় তাই কাটমানি চাইলে, নৈব নৈব চ!
কাটমানি রুখতে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের এই নয়া উদ্যোগ তাই নিজের ঘর নিজেই গড়ুন!
বিভিন্ন জেলায় কাটমানি নিয়ে যে অভিযোগের পাহাড় জমেছে, খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে তার সিংহভাগই ওই বাংলা আবাস যোজনাকে ঘিরে। মুর্শিদাবাদও তার ব্যতিক্রম নয়। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সেই অভিযোগের তালিকায় রয়েছে, বিভিন্ন পঞ্চায়েত এমনকি সরকারি কর্মীদেরও একাংশ। কাটমানি রোখার ছাড়পত্র পাওয়ার পরে এই নব-উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না যে!
জেলার প্রতিটি ব্লকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে লিফলেট-ব্যানার ছড়িয়ে প্রচারের পাশাপাশি তাই রিকশা কিংবা অটোতে চড়ে সরকারি কর্মীরাও নেমেছেন কাটমানির দাপট রুখতে। খড়গ্রামের ঝিল্লি গ্রাম পঞ্চায়েতে তেমনই এক সরকারি কর্মীর দেখা মিলল। বলছেন, ‘‘আমরা লিফলেট ছড়িয়ে প্রচার করছি। জটলায় দাঁড়িয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছি— কাউকে টাকা দেবেন না। ঘর পাওয়ার জন্য আপনি যদি টাকা দেন, আপনিও অপরাধী।’’ ঝিল্লি পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল কামারুজ্জামান সরকার বলছেন, “অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি টাকা না চাইলেও তাঁদের নামে করে, উপভোক্তাদের কাছ থেকে কাটমানি নেওয়া হচ্ছে। আর তার মাসুল গুনতে হচ্ছে ওই জনপ্রতিনিধিকে।’’ প্রচারে বেরনো সরকারি কর্মীরা সেই সঙ্গে যোগ করছেন— ‘‘আগে থেকে উপভোক্তাদের সচেতন করা হচ্ছে, যদি ঘর পাইয়ে দেওয়া নাম করে টাকা চান তবে ‘দিদিকে বলোর’ ফোন নম্বরে ফোন করে জানান।’’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালের আর্থ সামাজিক সমীক্ষার তালিকা অনুযায়ী এই প্রকল্পের উপভোক্তা চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ ‘বাড়ি পাইয়ে দেব’- স্রেফ এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোথাও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কোথাও বা পঞ্চায়েত কর্মী টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গিয়েছে, চলতি মাসের মধ্যে জেলার সব উপভোক্তাকে ওয়াকিবহাল করার ব্যাপারে ‘টার্গেট’ও বেঁধে
দেওয়া হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলাপরিষদ) সুদীপ্ত পোড়েল বলছেন, ‘‘২০১০ সালের আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলা আবাস যোজনা প্রকল্পে উপভোক্তা চিহ্নিত করা হয়েছে। উপভোক্তাদের ঘর পাওয়ার ক্ষেত্রে কারও ভূমিকা নেই। এটাই সমস্ত উপভোক্তাকে জানাতে বলা হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, বিডিও-রা উপভোক্তাদের ডেকে এ ব্যাপারে জানাতে পারেন, কর্মীদের প্রচারেও নামাতে পারেন। সে কাজটাই রোদে-পুড়ে-ভিজে করে চলেছেন প্রশাসনিক কর্মীরা।