মেয়ে কোলে কার্তিকের স্ত্রী সাবিত্রী। নিজস্ব চিত্র
মোবাইল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আচমকা বাবার ছবিটা বের করে ফেলেছিল ছোট্ট মেয়েটাৈ। নাম তার মিষ্টি।
সামনের বারান্দায় তার মা তখন বঁটিতে আনাজ কাটছিলেন। মায়ের গলা জড়িয়ে ছবিটা দেখিয়ে মিষ্টি জানতে চায়, “মা, বাবা কবে আসবে? আমরা ঠাকুর দেখতে যাব না?”
উত্তর দিতে পারেন না মা। মেয়ের মুখে-চুলে হাত বুলিয়ে আদর করেন। মুখে কথা সরে না। হাতের পুঁইশাকের ডাঁটা হাতেই থেকে যায়। চোখের কোলে গড়িয়ে আসে জল। বঁটির পাশে ছোট্ট প্লাস্টিকের ঝুড়িতে গোটা কতক প্রায় শুকনো পটল, আলু আর পিঁয়াজ। শুকিয়ে যাওয়া লঙ্কা বেছে রাখা হয়েছে এক কোণে। সবে দুপুরের রান্নার তোড়জোর চলছে।
গত বছর পুজোর ঠিক আগেই অভিজিৎ ওরফে কার্তিক বিশ্বাস খুন হয়ে যাওয়ার পরে পরিবারে শুধু শোক নয়, অভাবের ছায়াও নেমে এসেছিল। গত এক বছরে তা বাড়তে-বাড়তে চরমসীমা ছুঁয়েছে। কার্তিকের স্ত্রী সাবিত্রীর গয়না বন্ধক দিয়ে এত দিন কোনও মতে চলেছে। কিন্তু আর যে চলে না!
অগত্যা হার্টের অসুখে ভোগা কার্তিকের বাবা অমিত বিশ্বাস পঁয়ষট্টি বছরে এসে আবার বাসের লাইনে পা বাড়িয়েছেন। আবার কাজ নিয়েছেন কন্ডাক্টারের। এ ছাড়া যে উপায় নেই। মিষ্টি বড় হচ্ছে। তাকে এ বার স্কুলে ভর্তি করতে হবে। সেটাও তো একটা কম বড় চাপ নয়।
কিন্তু সব কষ্ট সহ্য করা যায়। সব যন্ত্রণা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মিষ্টি যখন বাবার জন্য বায়না ধরে, তখন কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না বছর চব্বিশের সাবিত্রী। ঘরের দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদেন। বিয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বামীকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা ডুকরে ওঠে।
কৃষ্ণনগরের চুনুরিপাড়ায় বিশ্বাস বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে বাড়ি চিকিৎসক কুমুদরঞ্জন বিশ্বাসের। তাঁর সঙ্গে-সঙ্গেই থাকতেন কার্তিক। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে ফেরার সময়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ির সামনেই হেলমেট পরা আততায়ী তাড়া করে এষে গুলি করেছিল কার্তিককে। পরে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করে। ওষুধ সংস্থার কমিশনের টাকা নিয়ে রেষারেষিতেই নাকি এই খুন।
ময়নাতদন্তের পরে কার্তিকের দেহ যখন বাড়ির সামনে আনা হয়, শুধু। মুখটা খুলে রাখা হয়েছিল। বাকি গোটা মাথা ব্যান্ডেজে মোড়া। পাড়ার এক পিসির কোলে চেপে মিষ্টি এক ঝলক দেখেছিল সে মুখ, শেষ বারের মতো। তার পর থেকে বাবার কথা উঠলেই সে বলে, ‘‘বাবার তো জ্বর এসেছিল। কপালে জলপট্টি দিয়ে সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। আর তো এল না!”
ঝিমঝিমে বৃষ্টি আর মেঘের আড়ালে রোদের রং বদলে গিয়েছে। আর দু’দিনেই গুড়গুড়িয়ে বেজে উঠবে ঢাক, কাছে-দূরে। পাড়ার কোনও পিসির হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বের হবে সাড়ে চার বছরের মিষ্টি। ঝলমলে আলো আর ভিড়ে মধ্যে হয়তো খুঁজবে বাবাকে, হয়তো খুঁজবে না।
সাবিত্রী বসে থাকবেন আঁধারে...।