মতিউরের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে তাঁর বাড়ির সামনে গ্রামের লোকজনের ভিড়। রবিবার সকালে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
গ্রামের নাম বোখরা। কিন্তু লোকজন বলেন— আর্মি গ্রাম!
ওই নামেই এই গ্রামকে চেনে তামাম সাগরদিঘি। এ গ্রামে ৩০ জনেরও বেশি লোকজন কাজ করেন সেনা, বিএসএফ কিংবা সিআরপিএফে। বোখরা মনে করিয়ে দিচ্ছে বিহার, ঝাড়খণ্ড বেশ কিছু গ্রামের কথা। কারণ, এই কারণেই মুখে মুখে পড়শি রাজ্যের সেই সব গ্রামের নাম হয়ে গিয়েছে জওয়ান গাঁও!
এই গ্রামেরই বাসিন্দা মির মতিউর রহমান নিহত হয়েছেন মাওবাদীদের গুলিতে। রবিবার সন্ধ্যায় তাঁর দেহ এসেছে গ্রামে। শোকস্তব্ধ সেই আর্মি গ্রামের বেশ কয়েক জন যুবক এ দিনও মতিউরের কফিনবন্দি দেহের সামনে দাঁড়িয়ে পণ করেছে, ‘‘আমরা ভয় পাইনি। তোমাকে দেওয়া কথা আমরা রাখব। আমরা সেনাবাহিনীতেই নাম লেখাব।’’
আরও পড়ুন
ছত্তীসগঢ়ে নিহত জওয়ান, শোকস্তব্ধ সাগরদিঘি
এই মুহূর্তে বোখরা গ্রামে জনা তিরিশেক যুবক সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন। কেউ কেউ রয়েছেন কয়েক পুরুষ ধরে। সেনাতে যোগ দেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন গ্রামের অন্তত আরও ৩০ জন যুবক। গ্রামের বছর আটচল্লিশের রফিকুল আলম ২৯ বছর ধরে রয়েছেন সেনাবাহিনীতে। এই মুহূর্তে তাঁর পোস্টিং কাশ্মীরের গোডায়। ২৮ দিনের ছুটিতে তিনি বাড়িতে এসেছেন। ফিরবেন ৪ নভেম্বর। তিনি মতিউরেরই পড়শি। মাওবাদী হামলায় মতিউরের নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি দুঃখ পেলেও ভয়কে পাত্তা দিচ্ছেন না। তাঁর বাবা মফিজুর রহমানও ছিলেন সেনাতে। ১৫ বছর সেনায় আছেন তাঁর ভাই আনিকুল আলম। ১৬ বছর ধরে সেনা বাহিনীতে কাজ করছেন তাঁর ভগ্নীপতি, বোখরার বাসিন্দা সইদুল ইসলামও। ক’দিন পরেই সেনাতে যোগ দেবে তাঁর বড় ছেলে মহনিশ আলমও।
রফিকুল বলছেন, “এই নিয়ে চার বার কাশ্মীরে। কার্গিল যুদ্ধেও যোগ দিয়েছি। আমার ভাইও আছে কাশ্মীরে। সব জেনেই তো এই কাজে যোগ দিয়েছি। ভয়ের কী আছে! আর তার পরেও যদি কিছু হয় তো হবে! তাই বিএ পাশ ছেলেকেও সেনায় পাঠাতে দ্বিতীয় বার চিন্তা করিনি। মতিউর আমাদের গর্ব।”
আরও পড়ুন
মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় সব শেষ! এই প্রথম বার কথা রাখল না মতিউর
তবে রফিকুলের স্ত্রী নয়নতারা বিবি বলছেন, “আমরাও সব বুঝি। পরিবারের এতগুলো লোক সেনাতে আছে। ফলে চিন্তা তো হয়ই।” ১৯৮৯ সালে সেনা বাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন গ্রামের পরেশ দাস। তিনি বলছেন, “১০ বছর কাশ্মীরে কাটিয়েছি। আমার এক ছেলেকেও সেনায় পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শারীরিক কারণে ওর চাকরিটা হয়নি। এখনও সকাল বিকেল এ গ্রামের বহু ছেলে দৌড়-ঝাঁপ করে। ওরা সকলেই সেনা, বিএসএফ কিংবা সিআরপিএফে যোগ দিতে চায়। মতিউরের খবর পেয়েও তারা এ দিন সকালে অনুশীলন করেছে।”
কথাটা কথার কথা নয়। গ্রামের ওবাইদুর রহমানের বাবা রহমতুল্লা শেখ সেনা থেকে অবসর নিয়েছেন। ভাই শেখ মজিবুর রহমান দু’বছর আগে যোগ দিয়েছেন সেই সেনাতেই। ওবাইদুর বলছেন, “এর আগে দু’বার চেষ্টা করেও পারিনি। তাই আবার চেষ্টা করছি। মতিউর চাচার মৃত্যুতে আমরা কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু জেদ আরও বেড়ে গিয়েছে।”
সেনাবাহিনীতে ঢুকতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না হাসান মণ্ডলও। তাঁর দুই কাকা আলি মুর্তুজা ও জাকারিয়া শেখ ২৪ বছর ধরে সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। হাসান বলছেন, “সেনাতে কাজ করাটা চ্যালেঞ্জের। আমরা সেই চ্যালেঞ্জটাই নিতে চাই।’’