উনিশটিকে ঘায়েল করে ঘুমিয়ে গেল হনু

টিনের ছাদ জুড়ে এই ফাগুনেও দেদার কচি লাউ। কাশিমবাজারের সর্বমঙ্গলবাবু মনে মনে একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলেছিলেন— অফিসের বড়বাবুকে বড়সড় দেখে একটা, পাশের বাড়ির ইশফাকদের গোটা দুয়েক আর বেলডাঙায় তাঁর ছোটমাসির বাড়ি কয়েকটা পাঠিয়ে দিতে হবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বহরমপুর শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৬ ০২:৩৭
Share:

ঘুমপাড়ানি তির (ডাট) গেঁথেছে পিছনে। তাই নিয়ে হনু মারল লাফ। সব ছবি: গৌতম প্রামাণিক

টিনের ছাদ জুড়ে এই ফাগুনেও দেদার কচি লাউ। কাশিমবাজারের সর্বমঙ্গলবাবু মনে মনে একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলেছিলেন— অফিসের বড়বাবুকে বড়সড় দেখে একটা, পাশের বাড়ির ইশফাকদের গোটা দুয়েক আর বেলডাঙায় তাঁর ছোটমাসির বাড়ি কয়েকটা পাঠিয়ে দিতে হবে। অমন কচি লাউ, সটান ছেলেবেলায় নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। অবসরের মুখে থমকে থাকা প্রৌঢ় সর্বমঙ্গলের সেই ফর্দটা ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে গিয়েছিল সেই দুপুরেই।

Advertisement

শুধু সর্বমঙ্গলবাবু কেন, হামলাটা ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের আরও খান কয়েক লাগোয়া পাড়ায়। প্রথমে টিনের ছাদ দাপাদাপি, তার পর হুজ্জুতির চড়তে থাকা পারদে ঠাঁই পেতে তাকে— ছিনতাই-লুঠ-হল্লা মারধর এবং পরিশেষে কামড়াকামড়ি। কাশিমবাজার জুড়ে সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড।

হাসপাতালের হিসেব বলছে, আহত উনিশ। তাঁদের মধ্যে ভর্তি বেশ কয়েক জন। এমনকী আহত এক জনকে পাঠাতে হয়েছে কলকাতার হাসপাতালে। ছুটকো আঁচড়ের দাগ নিয়ে এই হিসেবের বাইরেও রয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক জন।

Advertisement

পুলিশ-পেয়াদা, বন দফতর—নাঃ সামাল দিতে পারেননি কেউই। বৃহলাঙ্গুলের ধারে কাছে ঘেঁষতে গেলেই দাঁত খিঁচিয়ে এমন ‘গালমন্দ’ শুনতে হয়েছে যে থানার বড়বাবুও পিঠটান দিয়েছেন। এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘শহরের খুনে-গুন্ডাদেরও কাছেও এমন হেনস্থা হয়নি!’’ শেষতক তাই গুলির ফতোয়াই ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন থানার বড়বাবু।

তবে, তা আর ছুড়তে হয়নি। বন দফতরের রেঞ্জ অফিসারই ঘুমপাড়ানি ডার্ট ছুড়ে ঘুম পাড়িয়েছিলেন তাঁকে।

ডার্টের ঘায়ে ঘুমিয়ে কাবু সেই হনুমানকে সোমবার বস্তাবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বন দফতরের কয়েদখানায়। দিন কয়েক রেখে তাকে পর্যবেক্ষণ করে তবেই ছাড়া হবে দূরের কোনও বনে। এমনই জানিয়েছেন বনকর্তারা।

সোমবার, হাঁফ ছাড়া কাসীমবাজার বলছে— স্বস্তি বলতে এইটুকুই।

আরও পড়ুন
বহরমপুরে হনুমানের তাণ্ডব

দিন দুই ধরে তাঁদের জীবন ‘অতিষ্ঠ’ করে তোলা সেই সব দুপুরের স্মৃতি ঘেঁটে কাশিমবাজারের সার ব্যবসায়ী স্বপন খান বলছেন, ‘‘সে কি তাড়া রে বাবা, লাঠি ফেলে দৌড়ে কুল পাই না। ধুতির কাছা খুলে যাওয়ার জোগাড়।’’ এই ক’দিনের অভিজ্ঞতা উপুড় করে এমন সব রোমহর্ষক আর হাস্যরসে ঠাসা গপ্প অবশ্য আস্তিন থেকে বের করছেন আরও অনেকে। তাঁদের কেউ বলছেন, ‘‘গত দু’টো দিন প্রায় দম বন্ধ করে ছিলাম।’’

ঘটনাটার শুরু শনিবার। কাশিমবাজারের শ্রীপুরপাড়া, ব্রহ্মময়ী মন্দির, ভাটপাড়া, কোনাইপাড়া, মনীন্দ্রনগর কলোনি জুড়ে আচমকাই উদয় হয় এর হনুমানের। প্রথম দিকে দাঁত খিঁচিয়ে কলা-মুসো-লাউ-পেয়ারা লুঠতরাজেই প্রহর কাটছিল তার। বাধা পেলেই অবশ্য কামড় দিতে শুরু করেছিল। পুলিশ বলছে— গত দু’দিনে ওই হনুমানটির আক্রমণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৯ জন। তার মধ্যে শনিবার তিন জন এবং রবিবার এক জনকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এক জনকে পাঠানো হয়েছে কলকাতার হাসপাতালে।

মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হনুমানের আঁচড়-কামড় নিয়ে যাঁরা এসেছিল তাঁদের কয়েক জনের জখম গভীর। অন্তত ১২ জনকে চিকিৎসা করেছি।’’

হনুমানের অত্যাচারর প্রথন শিকার দশম শ্রেণির ছাত্রী নন্দিতা সাহা। কিশোরীর বাবা বলছেন, ‘‘মেয়েটার জ্বর, স্কুলে না গিয়ে বাড়ির বারান্দায় বসে ছিল। হনুমানটা এসে কিছু বোঝার আগেই পায়ে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল!’’ হনুমানের হামলায় গুরুতর জখম হয়েছেন মণীন্দ্রনগর স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সমীর দাসও। ওই অবস্থাতেই সোমবার সে গিয়েছে বোর্ডের পরীক্ষা দিতে। আর, বাড়ির ছাদের বসে বিড়ি খাওয়ার সময়ে বেমক্কা হুনুর হানায় রক্তাক্ত হয়েছেন লটারি বিক্রেতা সমীর দাস। বলছেন, ‘‘সে কী হাঁ মুখ রে বাবা!’’ কাজল মণ্ডলের অভিজ্ঞতা অন্যরকম। তিনি বলছেন, ‘‘আরে, কখনও শুনেছেন রাতে হনুমান হামলা চালায়? রাতে খাওয়ার পরে পায়চারি করছিলাম, পিছন থেকে এসে তাঁকে কামড়ে দিয়ে পালাল।’’

বেগতিক দেখে বনদফতরের কর্মীদের পরামর্শে পাড়ার কয়েক জন যুবক বাজি-পটকা ফাটিয়ে তাকে পাড়া-ছাড়া করার একটা চেষ্টা করেছিল বটে তাতে হিতেবিপরীত হয়।

কথনও গাছের মগডালে, কখনও তিনতলা বাড়ির ছাদে উঠে বসে থাকে সে। বন দফতরের কর্মীরাও দু’দিনে তার নাগাল পাননি।

বনদফতরের রেঞ্জ অফিসার অমিতাভ পাল বলেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়ে হনুমানটিকে কাবু করা গিয়েছে।’’ মুর্শিদাবাদ জেলা পশু হাসপাতালের চিকিৎসক শুরু করেছেন তার পরীক্ষা। বলছেন,
‘‘কেন এমন মারমুখী হয়ে উঠল দেখি। শরীরে কোনও আঘাত থাকতে পারে।’’ তার পর?

বনকর্মীরা বলছেন, ‘‘ভয় নেই, দূরে কোথাও ছেড়ে আসা হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement