প্রতীকী ছবি।
চাপা আশঙ্কা ছিল, স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালে অস্পষ্ট ভাঁজও চোখ এড়ায়নি। তবু, প্রান্তিক জেলা মুর্শিদাবাদে কোভিড সংক্রমণ তার পড়শি জেলা তো বটেই গায়ে গা ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের জেলাগুলির তুলনায় নিতান্ত স্বল্প। জনঘনত্ব বিপুল, আর্থিক ভাবে তেমন স্বচ্ছল নয়, যোগাযোগ থেকে চিকিৎসা প্রতিবেশী জেলাগুলির তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে থাকা জেলায় করোনা-সংক্রমণকে এমন বেঁধে রাখা গেল কী করে তা খোদ স্বাস্থ্যভবনের কর্তাদের আলোচনাতেও প্রসঙ্গটা উঠে এসেছে বারবার।
নওদা থেকে ডোমকল, জঙ্গিপুর কিংবা আরও প্রত্যন্ত জলঙ্গি— জেলার বেশ কিছু এলাকা বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। বিএসএফ ছাড়া সেই সব জায়গায় স্থানীয় জপ্রতিনিধিদের পা তেমন পড়ে না। রয়েছে বেশ কিছু চর। চিকিৎসা অনেক পরে, হাজার হাজার মানুষের সেই দীপান্তরিত দিনযাপনের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগও বেশ কঠিণ। নবাবি ঠাঁটের প্রায় সবটুকু হারানো জেলায় জনঘনত্ব চোখে পড়ার মতো, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৩৩৪ জনের বসবাস। লকডাউনের প্রথম পর্বের মাঝামাঝি তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের মরিয়া আশা নিয়ে ঘরে ফেরা।
কিন্তু তা সত্ত্বেও হুহু করে সংক্রমণ ছড়ানোর বদলে তা বাঁধা থেকেছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। স্বাস্থ্যভবনের খবর, এ ব্যাপারে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের পাশাপাশি আশাকর্মী, জেলার আপামর মানুষের সচেতনতা এবং অবশ্যই সরকারি হাসপাতালগুলির তৎপরতা কোভিডকে কখনওই মাত্রা-ছাড়া হতে দেয়নি।
তাই পড়শি দুই জেলা মালদহ, কিংবা নদিয়ায় লোকসংখ্যা এবং জনঘনত্ব আংশিক কম হওয়া সত্ত্বেও যখন গত পাঁচ মাসে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে ৫৬০০ এবং ৫৩০০ হলেও মুর্শিদাবাদে তা ৪৩০০ ছোঁয়নি।
জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা বলছেন, ‘‘স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমরা ভেবেছিলাম এ জেলায় সংক্রমণে উজাড় হয়ে যাবে গ্রাম। কিন্তু হল ঠিক উল্টোটা। অন্যত্র গোষ্ঠী সংক্রমণের ইশারা মিললেও এ জেলায় এখনও তা হয়নি। তার বড় কারণ, মানুষের সচেতনতা।’’ মুর্শিদাবেদর নওদা, কান্দি, জঙ্গিপুর কিংবা বরহমপুরের লাগোয়া কিছু এলাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৪৫০ জনের বসবাস। গড় ১৩৩৪। তুলনায় মালদহের জনঘনত্ব ১০৬৯জন, নদিয়ার ১৩১৬। কিন্তু জনসংখ্যার এমন গা ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থান সত্ত্বেও। সামাজিক দূরত্ব বিধি এবং লকডাউনে নিয়ম মেনে চলায় মুর্শিদাবাদ যে পড়শি জেলাগুলির তুলনায় এগিয়ে তা মেনে নিচ্ছে স্বাস্থ্যভবন। রাজ্যের এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক যখন মুর্শিদাবাদে নেমেছে, আমরা ভেবেছিলাম এ বার হুহু করে করোনা ছড়াবে। কিন্তু স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতর এ ব্যাপারে খুবই ভাল কাজ করেছে। তেমনই সঙ্গত করেছে জেলা প্রশাসন।’’
পরিযায়ীরা ট্রেন থেকে নামামাত্র, তাঁদের স্যানিটাইজ করার পাশাপাশি জল এবং খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দেওয়া, কোয়রান্টিনের ব্যবস্থা করা, সেফহোমের সুবন্দোবস্ত— খামতি ছিল না। জনঘনত্ব বেশি হলেও মুর্শিদাবাদ প্রশাসনের এই আন্তরিকতায় সাড়াও দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং পরিযায়ীরা। ব্যতিক্রম থাকলেও, ভিন-জেলা বা রাজ্য থেকে আসা কর্মীরা নিয়ম মেনে আইসোলেশনে থেকেছেন বলেই জানাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। পাশাপাশি এ ছবিও চোখে পড়েছে— ভিন রাজ্য ফেরত পরিযায়ীরা গ্রামে ঢুকতে গেলে বাড়ির লোকই তাদের বাধা দিয়েছে, পাঠিয়েছে কোয়রান্টিনে। অতিমারি রুখে দেওয়ার এই প্রাথমিক শর্তগুলি মেনে চলা হয়েছে যথাযথ ভাবে বলে মনে করছে স্বাস্থ্যভবন।
জেলার মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক প্রশান্ত বিশ্বাস তাই বলছেন, ‘প্রথম থেকেই আমরা তৎপর থেকেছি। মানুষও সাড়া দিয়েছে।’’