প্রতীকী ছবি।
সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের হার বাড়ানোর লক্ষ্যে বেশ কিছু দিন ধরেই প্রচার চালাচ্ছিল স্বাস্থ্যভবন। পিছিয়ে থাকা জেলা মুর্শিদাবাদে সেই চেষ্টায় প্রচারের কাজে আশাকর্মী থেকে স্থানীয় মসজিদের ইমামদেরও পাশে পেয়েছিল প্রশাসন। সাফল্য মিলেছিল অচিরেই। সেই নিরলস প্রচার যে গ্রামীণ মানুষের সংস্কার মুছে দিয়েছে অনেকটাই, দীর্ঘ লকডাউনেও তার প্রমাণ মিলল। যোগাযোগহীন গত আড়াই মাসে করোনা-আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালগুলি মুখ ফেরালেও মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগের পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে। স্বাস্থ্যভবনও মনে করছে, মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ এলাকার প্রসূতিদের হাসপাতালমুখী করে তোলার এই সাফল্য রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন পালক যোগ করেছে।
শুধুই প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নয়, সরকারি ওই হাসপাতালে লকডাউনের সময়ে সাধারণ প্রসবের পাশপাশি এলইউসিএস বা অস্ত্রোপচার করে প্রসবের হারও বেড়েছে বহুলাংশে। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রসবের হার ছিল ৬৭ শতাংশ। তার মধ্যে ২৯ শতাংশ প্রসব অস্ত্রোপচার করে হয়েছে। বাকি ৩৮ শতাংশ সাধারণ পদ্ধতিতে প্রসব হয়েছে। ২০১৯’র এপ্রিলে এই হার ছিল ৪৭ শতাংশ। অস্ত্রোপচার করে প্রসব হয়েছিল মাত্র ১৬ শতাংশ। লকডাউন শিথিল হওয়ার পর জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে সেই প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার আরও বেড়েছে বলে দাবি ওই বিভাগের।
করোনা সংক্রমণ শুরু হতেই জেলার অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অস্ত্রোপচারই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি, প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করা প্রসূতিদের ক্ষেত্রেও দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শও পাননি প্রসূতিরা। এই সময়ে ভরসা হয়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মাতৃমা বিভাগ। স্বাভাবিক ভাবেই তাই হাসপাতালে সন্তান প্রসবের হার অন্য বছরের তুলনায় হুহু করে বেড়ে গিয়েছে। হাসপাতালের ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজশেখর সরকার বলছেন, “লকডাউনের সময় জটিল সমস্যা নিয়ে প্রতি দিন গড়ে দু’-তিন জন প্রসূতি চিকিৎসার জন্য এসেছেন হাসপাতালে। তার মধ্যে অন্তত চার জন জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীও ছিলেন।” তাঁদের চিকিৎসার ভার তুলে নিয়েছিল টিম মাতৃ-মা। সে কথা স্বীকার করছেন রোগীর বাড়ির লোকজনও। নদিয়ার কালিগঞ্জের বাসিন্দা আমিরুল ইসলামের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন মণ্ডল বছর খানেক ধরে জটিল স্ত্রী রোগে ভুগছিলেন। লকডাউনের সময় তাঁর অসুস্থতা বাড়লে ভরসা ছিল সেই মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালের মাতৃমা। আমিরুল বলেন, “সেই সময় সব বন্ধ। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল না থাকলে মরণাপন্ন স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলাই যেত না।” শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, এই সময়ে পড়শি জেলা এবং রাজ্য থেকেও বহু প্রসূতি এসেছেন ওই হাসপাতালে। নদিয়া, বীরভূম এমনকি পড়শি রাজ্যের ঝাড়খণ্ডের অনেক প্রসূতির কাছেও শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই হাসপাতাল।
প্রসূতিরোগ বিভাগের প্রধান ও মেডিক্যাল ডিন, ভাস্করানন্দ শীল বলেন, “এমনিতেই উচ্চরক্তচাপ ও অল্পবয়সে মা হওয়াই জেলায় প্রসূতিদের মৃত্যুর কারণ। তবে গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসকদের পরামর্শের পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তে তাদের সচেতন করায় গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যূহার এখন অনেকটা কমেছে। বিশেষ করে লকডাউনের এই দীর্ঘ সময়ে।’’ হাসপাতালের সুপার শর্মিলা মল্লিক বলেন, “লকডাউনের সময় যানবাহন না চলায় আবার করোনা ভয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের প্রবণতা ফিরেছে। এটা আমাদের বড় সাফল্য।’’
অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার সেমন্তী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দিনের শেষে সদ্যোজাতর হাসিমুখ দেখতে পাওয়াটা বড়ই আনন্দের।’’