প্রতীকী ছবি।
কলেজপাড়ায় পদার্থবিদ্যার শিক্ষক রাজীব বিশ্বাস প্রতি দিন তিনটি ব্যাচে জনা ষাটেক ছাত্রীকে টিউশন পড়ান। স্কুলের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি এবং কলেজের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের শতাধিক ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে পড়ে।
করিমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অপর এক গৃহশিক্ষক অরবিন্দ স্বর্ণকার বিভিন্ন কলেজের কলা বিভাগের পড়ুয়াদের ইতিহাস পড়ান। তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও দেড়শোর বেশি। রাজীব বা তিনি কোনও স্কুল বা কলেজে পড়ান না। শুধুই টিউশন।
ওই গার্লস স্কুলের কাছেই ঘর ভাড়া নিয়ে কিন্তু রসায়ন পড়ান সীমান্তবর্তী উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। তাঁর পড়ুয়ার সংখ্যাও একশোর কাছাকাছি। করিমপুরের ধোড়াদহ হাইস্কুলের এক শিক্ষক জীবনবিজ্ঞান পড়ান প্রায় দুশো ছাত্রছাত্রীকে। এমন উদাহরণ আরও বেশ কিছু আছে। রোজই নাম করা বিভিন্ন কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের বাড়িতে সকাল থেকে রাত অবধি করিমপুর শহর ও আশপাশের গ্রাম-মফস্সল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করে। শিক্ষকদের মধ্যে এক দল স্কুল-কলেজেও পড়ান, আর এক দল শুধুই প্রাইভেট টিউশন করেন।
দীর্ঘদিন ধরে এই কারবার ভালই চলছিল। কিন্তু ‘প্রাইভেট টিউটর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ শিক্ষা দফতরে টিউশন করা স্কুলশিক্ষকদের নামের তালিকা জমা দেওয়ার পরেই গোলমাল বাধে। এর পরেই স্কুলের শিক্ষকদের কেউ টিউশন পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন, কেউ কিছু দিনের জন্য বন্ধ রেখে ফের শুরু করেছেন। কেউ-কেউ আবার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। লোকের চোখ এড়াতে কেউ বাড়ির বাইরে ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল রাখতে দিচ্ছেন না, বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে রাখতে বলছেন।
‘প্রাইভেট টিউটর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য রাজীব বিশ্বাসের দাবি, স্কুলশিক্ষকদের একটা অংশ বাড়তি টাকা রোজগারের জন্য সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে এখনও টিউশন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বছর বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্কুল ও সেগুলির শিক্ষক তালিকা জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রাইভেট টিউশন কারা করছেন, তালিকায় তা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। করিমপুর এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৪ জন ও উচ্চ বিদ্যালয়ের মোট ৪৪ জন শিক্ষকের নাম রয়েছে, যাদের মধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরাও রয়েছেন। করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের আট জন, মহিষবাথান স্কুলের ছ’জন, যমশেরপুর স্কুলের তিন জন শিক্ষকের নাম তালিকায় রয়েছে।
রাজীব আরও জানান, করিমপুর ও আশপাশের এলাকার স্কুলে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা খুব কম। যেমন, করিমপুর জগন্নাথ স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে ৬০ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪০ জন, যমশেরপুরে যথাক্রমে ৪০ ও ৩৬ জন, শিকারপুরে ১১ ও ২ জন, হোগলবেড়িয়া স্কুলে মোটে ১ ও ২ জন। মহিষবাথান নন্দনপুর স্কুলেও বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্রসংখ্যা সীমিত। ফলে ওই স্কুলগুলিতে বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত আদৌ কম নয়। প্রতিটি স্কুলে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা অঙ্ক পড়ানোর জন্য এক জন বা তার বেশি শিক্ষক আছেন। কিন্তু তার পরেও স্কুলের বইয়ের পাঠ্যসূচি শেষ হয় না।
কোথাও চাকরি না করা প্রাথমিক শিক্ষকদের অভিযোগ, স্কুলশিক্ষকদের বেতনের জন্য আয়কর দিতে হয়, কিন্তু টিউশন পড়ানোর রোজগারের জন্য কোনও কর তাঁরা দেন না। তবে গোটা বিষয়টি অস্বীকার করে করিমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে রসায়ন পড়ানো স্কুলশিক্ষক দাবি করেন, সরকারি আচরণ বিধি মেনে গত ১০ জানুয়ারি থেকে তিনি টিউশন পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ধোড়াদহ স্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক আবার পাল্টা বলেন, “রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট ভাবে শিক্ষকদের টিউশন পড়ানো বন্ধ করে দিলে আমিও আর পড়াব না।”