ডলি সরকার ও তপন বিশ্বাসের বাড়ি। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
আমপানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতির শিকড় যে অনেক গভীরে ছড়িয়েছে, ক্রমশ তার প্রমাণ মিলছে।
প্রকৃত ঝড়-বিধ্বস্থ মানুষের বদলে সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা অবস্থাপন্ন এবং প্রভাবশালীদের অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে বলে অভিযোগে আপাতত জেলা তোলপাড়। অভিযোগ যে সত্যি তার একাধিক অকাট্য প্রমাণও মিলেছে। তাতে যথেষ্ট অস্বস্তিতে শাসক দল। কারণ, অভিযুক্তদের অধিকাংশই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে টাকা পেয়ে গিয়েছেন। অথচ, তাঁদের পাকাপোক্ত বাড়ির কোনও ক্ষতি ঝড়ে হয়নি।
কল্যাণীর মদনপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মাজদিয়ায় ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে এমন দুর্নীতির ব্যাপারে কল্যাণী ব্লকের বিডিও দীপ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সম্প্রতি একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা তথা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নারায়ণ হালদার।
আনন্দবাজার পত্রিকার তরফে এ ব্যাপারে ওই সব বাড়ি ঘুরে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। প্রশাসনিক মহলেও এ ব্যাপারে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, মদনপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে অভিযোগ আসার পর ওই দুই গ্রাম পঞ্চায়েতে ব্লকের পদস্থ কর্তারা নিজেরাই ক্ষতিপূরণপ্রাপকদের বাড়ি ভেঙেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা শুরু করেছেন। তাঁদের অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্লকের এক কর্তা বলেন, এরই মধ্যে কয়েক জন টাকা ফেরতের ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, টাকা দেওয়ার আগে কেন বাড়ি-বাড়ি ঘুরে আবেদনকারীর সত্যতা যাচাই করা হয়নি?
কল্যাণীর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি পঙ্কজকুমার সিংহ বলছেন, ‘‘ওই পঞ্চায়েতে আমপানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। ১২৮ জন ক্ষতিগ্রস্তের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তার মধ্যে অনেকেই ওই টাকা পাওয়ার যোগ্য নন। এ নিয়ে দলীয় স্তরে তদন্ত হবে।’’
ক্ষতিপূরণপ্রাপকদের তালিকায় নাম রয়েছে আলাইপুর এলাকার এমন কয়েক জনের বাড়ি যাওয়া হয়েছিল শুক্রবার। তাঁদের এক জন কমল সরকার। ঝড়ে তাঁর পাকা বাড়ির কোনও ক্ষতিই হয়নি। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আসলে উঠোনের এক পাশে রান্নাঘরটা আগেই ভেঙেছিল। তাই ভাবলাম, টাকার আবেদনটা করেই দিই। তবে রান্নাঘর সারাতে তো অত টাকা লাগবে না। বাকি টাকা দিয়ে শোওয়ার ঘরটা আরও একটু ভাল করব।’’ কমলবাবু সম্পর্কে পঞ্চায়েত সদস্য খোকন সরকারের তুতো ভাই।
ওই এলাকার বাসিন্দা ডলি সরকার ও পূজা সরকারের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। তাঁর রঙ করা পাকা বাড়ি। গোয়ালঘরটা সারানোর জন্য শাসকদলের স্থানীয় এক নেতার মাধ্যমে তিনি ঝড়-বিধ্বস্ত হিসাবে আবেদন করে ফেলেন। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমার অ্যাকাউন্টে ওই টাকা এসেছে কিনা জানি না। এখনও ব্যালেন্স যাচাই করিনি।’’
আলাইপুর এলাকারই আরেক বাসিন্দা তপন বিশ্বাসেরও একতলা পাকা বাড়ি। সম্প্রতি দোতলা তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন। এ দিন তাঁর বাড়ি গিয়ে জানা গেল, সস্ত্রীক তিনি বাইরে গিয়েছেন। বাড়িতে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি। তিনি দাবি করেন, ‘‘আসলে বাড়ি থাকলেও তপন পাকা ঘরে থাকেন না। পাশে অন্য একটি ঘরে থাকেন। সেই ঘরের চালের ক্ষতি হয়েছে ঝড়ে।’’ ফোনে তপন বললেন, ‘‘ টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে কিনা জানি না।’’ কল্যাণীর বিডিও দীপ চট্টোপাধ্যায়ের ফোন এ দিন বন্ধ ছিল। আর পঞ্চায়েতপ্রধান কুমুদ সরকার বলেন, ‘‘ঘর ভেঙেছে বলে দাবি করে অনেকে আবেদন করেছিলেন। পঞ্চায়েত সেই আবেদনপত্র ব্লকে পাঠিয়েছিল। আবেদনকারীদের সত্যি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার কথা ব্লক থেকে বলা হয়নি। পঞ্চায়েত আবেদনপত্রগুলি পৌঁছে দিয়ে কেবল পিওনের কাজ করেছে। ফলে এর মধ্যে পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকা নেই।’’