কুকুর চিহ্ন নিয়েই কার্তিক দত্ত নামলেন ভোটের ময়দানে।
ফরওয়ার্ড ব্লকের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন ইসলামপুর চক এলাকার কার্তিক দত্ত। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কার্তিকের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল, এক বার অন্তত তাঁকে পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী করা হোক। কিন্তু দল কথা রাখেনি।
ক্ষোভে, অভিমানে কার্তিক সিদ্ধান্ত নেন, ভোটে তিনি দাঁড়াবেনই। শেষ পর্যন্ত নির্দল প্রার্থী হয়েই ভোটে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। আর কার্তিকের কপালও তেমনি! নির্বাচন কমিশন তাঁকে প্রতীক দিলেন— কুকুর।
কুকুর প্রতীক পেয়ে প্রথমে বেজায় চটে গিয়েছিলেন কার্তিক। ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ উগরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এ তো শুরু থেকেই প্রহসন হে! হাতি নয়, ঘোড়া নয়, নিদেনপক্ষে গরু-ছাগলও নয়, কুকুর!’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শোনা যায়, প্রতীক বদলাতে চেয়ে তিনি ব্লক অফিসেও বার কয়েক দরবার করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। অতএব, কুকুর চিহ্ন নিয়েই তিনি নামলেন ভোটের ময়দানে। কিন্তু কে আঁকবে এই সারমেয়-প্রতীক?
কার্তিকের অনুগামীরা জানিয়ে দিলেন, হাত, কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা সহজ। সিংহ আঁকার জন্যও একটা ছাঁচ আছে। কিন্তু কুকুর আঁকা তাঁদের কম্ম নয়!
দল কথা রাখেনি। অনুগামীরাও এ ভাবে অজুহাত দিয়ে সরে যেতে চাইছে! কার্তিক জানিয়ে দিলেন, দরকার নেই প্রতীক আঁকার। তিনি জ্যান্ত প্রতীকের উপরেই ভরসা রাখবেন।
ব্যস! যেমন কথা, তেমনই কাজ।
প্রতিদিন সকালে একটা থলেতে পাউরুটি আর বিস্কুট নিয়ে পাড়ায় বেরিয়ে পড়তে শুরু করলেন কার্তিক। তাঁর গ্রাম সংসদের যে কুকুরগুলোর দিকে কেউ কোনও দিন ঘুরেও তাকাতেন না, সেই কুকুরগুলোকেই কার্তিক পাউরুটি, বিস্কুট খাওয়ানো শুরু করলেন। কখনও কখনও বাজার থেকে আনতেন মাংসের ছাঁট।
এমন প্রভু পেয়ে সারমেয়র দলও ভক্ত হয়ে গেল। প্রতীক দেওয়ালে আঁকা না হলেও জ্যান্ত কুকুর দেখেই তামাম এলাকা জেনে গেল, কার্তিক কোন চিহ্নে ভোট চাইবেন।
এ দিকে, কার্তিক প্রচারে যান। সঙ্গে গোটা বিশেক কুকুর। বাজারে গেলেও ল্যাজ নাড়তে নাড়তে পিছু নেয় তারা। বাড়িতে থাকলেও বাড়ির সামনে শুয়ে থাকে তারা। কার্তিক জ্যান্ত প্রতীকের ভক্তি দেখে বেশ তৃপ্ত। গিন্নিকে তিনি বলতেন, ‘‘মানুষ নুন খেয়ে ভুলে যায়। কিন্তু এগুলোকে দেখ, আমাকে কেমন চোখে হারাচ্ছে!’’
কিন্তু একটা সমস্যা হল। ভোটারদের অনেকেরই কুকুরে অ্যালার্জি আছে। তাঁরা দূর থেকে কার্তিক আর তাঁর সারমেয়র দল দেখলেই ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতেন।
তার পরে কার্তিক বাড়ির কাছাকাছি এলেই তাঁরা বলতেন, ‘‘কার্তিকদা, আপনার কোনও চিন্তা নেই। ভোট আপনাকেই দেব। তবে ওই আপদগুলোকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান।’’
কেবল ভোটারই নয়, কার্তিকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পুরিলাল বিশ্বাসও খোঁজ নিতেন, কোন এলাকায় কার্তিক প্রচার করছেন। কারণ, কুকুরের ভয়ে তিনিও তটস্থ থাকতেন!
স্থানীয় বাসিন্দা তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মী সাধন দে বলছেন, ‘‘আমরা তখন ছোট। কুকুর নিয়ে কার্তিককাকুর ভোট প্রচারের সেই দৃশ্য আজও মনে আছে।’’
বিপদ বাড়ল ভোটের ফল বেরোনোর পরে। জামানত জব্দ হওয়ার পরে কার্তিক ঘর থেকে ক’দিন বেরোলেন না। কিন্তু কুকুর কি আর হার-জিত, জামানত-টামানত বোঝে! তারা খাবার না পেয়ে ঘোরা শুরু করল কার্তিকের বাড়ির চারপাশে। পাড়ার কয়েক জনকে কামড়েও দিল।
স্থানীয় বাসিন্দা ধীমান দাস বলছেন, ‘‘বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, বাড়িতে গিন্নির বকুনি মিলিয়ে কার্তিকের তখন ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা।’’
সেই প্রথম। এবং সেই শেষ।
কার্তিক আর ভোটে দাঁড়ানোর কথা মুখে আনেননি। শুধু কাছের এক বন্ধুকে তিনি বড় দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘সিংহই ভাল ছিল রে! ভোট মিটে যেত, ল্যাটা চুকে যেত। এ ভাবে অন্তত পিছু নিত না!’’