woman

মৃত্যুর চেয়ে বড়, এই শেষ কথা

সেই মেয়েটা দুম করে মরে গেল। ঘর শূন্য। শব্দগুলোও গায়েব। শুধু ঢাকের শব্দ তাই বিষ লাগে মা-বাবার কানে। তাই ওঁরা পুজোর ক’দিন পালিয়ে যান কলকাতা ছেড়ে।

Advertisement

চৈতালি বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:০১
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ঢাকের শব্দ সহ্য হয় না। কান জ্বালা-জ্বালা করে। তাই পুজো সময়টা প্রতি বার পালিয়ে যান ওঁরা। ওই যখন থেকে আকাশে নীল রঙের মেঘ চুঁইয়ে বাড়ির বারান্দায় রোদ এসে পড়ে, তখন থেকেই বুকের ভিতরটায় কেমন দলাপাকানো কষ্ট ঘোরাফেরা করে। ওই যেমন তুলতুলে, দলাপাকানো এক মাংসপিণ্ড হাসপাতাল থেকে ঘরে এনেছিলেন ওঁরা। পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সেটাও ছিল পুজোর সময়ে। সদ্যোজাতকে নিয়ে ব্যস্ততায় সে বার কারও ঠাকুর দেখতে যাওয়া হয়নি। ঢাকের শব্দে চমকে-চমকে উঠছিল দিন পনেরোর শিশু। আর বুকে মধ্যে আগলে, শক্ত করে জড়িয়ে ছিলেন তাকে শিশুর মা।

Advertisement

শেষ বারও জড়িয়েছিলেন। যখন শ্মশানের চুল্লিতে ঢোকানো হবে ওই সন্তানকেই। জ্বলজ্যান্ত বছর পঁয়ত্রিশের মৃত মেয়েকে।

পুজোর চারটে দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। মেয়ে যখন ঘরে ছিল, পুজোর ওই তো সব চেয়ে বেশি হুল্লোড় করত। নতুন জামাকাপড় কেনা, পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের নতুন জামা বিলি, পুজোর ক’দিন বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের ডেকে হইহল্লা, খাওয়াদাওয়া। ঘরবাড়ি মাতিয়ে রাখত মা-বাবার একমাত্র আদরের সন্তান।

Advertisement

সেই মেয়েটা দুম করে মরে গেল। ঘর শূন্য। শব্দগুলোও গায়েব। শুধু ঢাকের শব্দ তাই বিষ লাগে মা-বাবার কানে। তাই ওঁরা পুজোর ক’দিন পালিয়ে যান কলকাতা ছেড়ে। দূরে কোথাও। যেখানে মেয়ের অতীতের হইহুল্লোড়ের শব্দগুলো নিভৃতচারণ করা যায়। কাঁদা যায়।

ঢাকের শব্দ বিষ লাগে মেয়ে-মরা মা-বাবার কানে।

কিংবা ওই ছেলেটার মা-বাবা। কেমন আছেন ওঁরা? পুজোর মাত্র ক’মাস আগে যাঁরা সন্তানের শ্রাদ্ধকাজ সেরেছেন?

কলকাতা পৌঁছেই মায়ের জন্য একটা ছাতা কিনেছিল ছেলেটা। সে ছাতা আর মায়ের হাতে দেওয়া হয়নি তার। কোনও এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের ঘরেই থেকে গিয়েছিল।। হয়তো সে থাকলে এই পুজোতেই ছাতা হাতে মাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোত। কিংবা গত বছরের মতো বাবাকে নিয়ে সুদূর নদিয়া থেকে ঘুরে যেত বেলুড়মঠ।

নদিয়ার ওই ঘরটাও তো এই পুজোয় ফাঁকা পড়ে থাকবে। যেখানে গত পুজোয় মায়ের হাতে-হাতে ধুলো ঝেড়ে, বিছানায় নতুন চাদর পেতে দিয়েছিল বাড়ির বড় ছেলে। বাবা আর ভাই মজা করে বলেছিল— মায়ের ন্যাওটা! সেই শব্দটাই কেমন বদলে গেল ‘পুরুষালি’ হস্টেলে এসে। দিন-রাত কানের কাছে শুনতে হল ছেলেটা নাকি ‘মেয়েলি’!

ওই ঘরে ‘মেয়েলি’ ছেলেটা এই পুজোয় আর নেই। তাই আর নতুন চাদরও পাতা হয়নি। মা-বাবা ভুলে গিয়েছেন পুজো কেমন হয়। ভাইয়ের কৈশোরও অকালে মরে গিয়েছে। কখনও হেসে ফেললে কেমন যেন নিজেকেই অপরাধী মনে হয় তার। যতই হোক, ক’দিন আগেই মরে গিয়েছে তার বড় দাদাটা।

হয়তো মরে যেত গণেশও। দেবতাদের গল্প বলে বাঁচানো হয়েছে।

‘শিবপুরাণ’-এ এর উপাখ্যানে লেখা— এক বার পার্বতী শিবের অনুচরকে নন্দীকে দরজার পাহারায় দাঁড় করিয়ে গেলেন স্নানে। এমন সময়ে শিব হাজির। নন্দী জানালেন— ‘‘ভিতরে ঢোকায় পার্বতীর নিষেধ আছে।’’ কিন্তু শিব মানলেন না। হাজির হলেন পার্বতীর স্নানকক্ষে। এতে অপমানিত পার্বতী গেলেন ক্ষেপে। সখী জয়া ও বিজয়ার পরামর্শে জল থেকে পাঁক তুলে, সুন্দর পুত্রের মূর্তি বানালেন। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে ব্যক্তিগত দ্বাররক্ষী নিয়োগ করলেন। এ বার ফের নতুন কুমারকে দ্বারে রেখে পার্বতী গেলেন স্নানে। ফের শিব এসে উপস্থিত। কুমার কিছুতেই শিবকে ভিতরে যেতে দেবেন না। এতে প্রথমে প্রমথগণের সঙ্গে কুমারের বিবাদ ও পরে পার্বতীর ইঙ্গিতে যুদ্ধ বাধল। প্রমথগণ, বিষ্ণু ও সব দেবতা যুদ্ধে হেরে গেলে, কূট পরামর্শ দিলেন নারদ। বিষ্ণু কুমারকে মোহাচ্ছন্ন করলেন। সেই ফাঁকে শিব শূল দিয়ে কুমারের মাথা কাটলেন। মারা গেলেন পার্বতীর পুত্র।

শোকে আকুল মা বিশ্বসৃষ্টি ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন। শেষে নারদ ও দেবগণ তাঁকে শান্ত করলেন। পার্বতী চাইলেন কুমারের পুনর্জীবন। শিব প্রমথগণকে উত্তরমুখে পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন, যাকে প্রথমে দেখা যাবে তারই মুন্ডু নিয়ে আসতে কুমারের জন্য। একদন্ত হস্তিমুণ্ড নিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁরা। ওই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই মাথা-কাটা যাওয়া কুমারকে জীবিত করা হল। হস্তিমুণ্ড ওই কুমার গণেশ নামে পরিচিত হলেন। সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে আজীবন গণেশজননী হওয়ার সঙ্গে আপস করলেন দেবী।

পুরাণের গল্প কখনও মিলে যায় বাস্তব জীবনের সঙ্গে। সন্তান হারানোয় বেদনা মিলিয়ে দেয় রক্তমাংসের মানুষ আর দেবীর অসহায়ত্ব। পুরাণ আসলেই বাস্তব। কিংবা বাস্তবকে মেনে নেওয়ার জন্যই লেখা লৌকিক দেব-মাহাত্ম্য। যাতে কষ্টের দিনগুলো পেরিয়ে যাওয়ায় বৈতরণী মেলে। অনেক সময়ে হয় না... নিজের ঘোর শোকের দিনে অন্যের কষ্টের কথা শুনে আমরা নিজেদের ভুলে থাকি। ভাবি, আসলে এত কিছুর পরেও কতটা ভাগ্যবান! অনেকটা সেই রকম।

গণেশজননী। অবনঠাকুরের তুলি-রং যে ছবি লেখে। মা পার্বতীর কোলে চড়ে শিশু খেলে বেড়াচ্ছে। ছোট সন্তানকে কোলে করে মা এগিয়ে দিয়েছেন গাছের দিকে। হাতি-মুখ শিশু তার শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে গাছের কাণ্ড। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে দেবীর মুখটা কখন যেন বদলে গিয়ে খুব চেনা লাগে।

চেনাই তো! এ ছবি আমাদের চেনা। রোজকার যাতায়াতে চোখে পড়ে। মায়ের কোলে চড়া খুদে। মেট্রো বা ট্রেনে। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ঝুলন্ত হাতলের দিকে। যার পা মাটি থেকে অনেক উপরে।

মায়ের কোলে সন্তান। এ এক চির আকাঙ্ক্ষিত, চির নিরাপদ স্থান। সব বিপদে, সব কষ্টে ‘ও মাগো’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা আমাদের জন্মগত অধিকার। তীব্র অসুখে, ঘুমহীন রাতে মায়ের কোল মনে পড়ে না, এমন পাষণ্ড ক’জন আছে? যুদ্ধের ময়দানে শেষ রক্তবিন্দু অবধি লড়ে আসে যে কর্ণ, সে-ও মৃত্যুর আগে মায়ের মুখ মনে করে। কোনও এক গোধূলি বিকেলে সে ফিরে যাচ্ছে কুন্তীর কোলে... আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়, এই শেষ কথা বলে যায় সে চলে।

ছেলের দেহটা দেখার পর থেকেই অনেক রাত ঘুমাতে পারেননি ওই মা। ঘুমের ওষুধ কাজ করেনি। শেষে স্নায়ু শান্ত করার ওষুধ দিতে হয়েছিল ডাক্তারকে। সন্তানকে ভুলিয়ে দেবে, এমন ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়েছে এই পৃথিবীতে?

যাদবপুরের প্রথম বর্ষের ছাত্রটি সাহিত্য ভালবাসত। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়বে ভেবে শহরে গিয়ে ভর্তি হয়। বাড়ি ছেড়ে হস্টেলে যাওয়ার আগে, মাকে পাশে নিয়ে বসে ব্যাগ গোছায়। তখনও সে জানত না, এই যাওয়াই হবে তার শেষ যাওয়া। আর ফেরা হবে মায়ের কাছে।

কেন ফাঁকা হয়ে গেল ওই মায়ের কোল? কার ভাগ্যদোষে?

কিংবা ওই মায়েরা? যাঁদের সন্তান র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে এখন জেলে? তাঁরাও তো চুন-খড়ি দিয়ে আল্পনা দিতেন ঘরে। পুজো-আর্চার দিনে স্নান সেরে, অষ্টমীর অঞ্জলিতে সন্তানের মঙ্গলকামনায় হাতজোড় করে এসে দাঁড়াতেন দেবীর সামনে। এ বছরে কি আর পারবেন? লোকচক্ষুর সামনে এসে দাঁড়াতে? ভাগ্যের ফেরে ওই মায়েরাও গণেশজননী। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কাটা পড়েছে আচমকা। বেঘোরে।

শরৎ জানে না এত সব কথা। সে ঋতু গুনে আসে। শিউলি ফোটায়, গন্ধ বিলিয়ে চলে যায়। কারও সন্তান ঘরে ফেরে। কারও ফেরে না। মণ্ডপে দুর্গা এলে ঢাক বাজে। ঠাকুরদালান পেরিয়ে শব্দ ঢুকে আসে ঘরে। বিছানায়।

ঢাকের শব্দে ওঁদের বিষণ্ণ লাগে। বিষ লাগে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement