ধৃত কুন্দনকুমার সিংহ (বাঁদিকে)। রানাঘাটে ডাকাতির পর পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় হেলমেট পরা কুন্দন (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা। গরিব সংসার। মাত্র ১০ বছর বয়সে ইটভাটায় কাজ শুরু। সেখানে কাঁচা ইট তৈরিতে মজুরির কারচুপির অভিযোগ করায় মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে এক জনকে কুপিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়া কিশোর ওই বয়সে তৈরি করে ‘শার্প বয়েজ়’ গ্যাং। এলাকার প্রভাবশালী এবং ধনী ব্যবসায়ীদের চমক-ধমকের সেই শুরু। তার পর কয়লা ব্যবসায়ী রাজু ঝা খুনে মূল অভিযুক্ত তথা রানাঘাটে ডাকাতির ঘটনায় মূলচক্রী কুন্দনকুমার সিংহের নাম জড়ায় একের পর এক মামলায়। রানাঘাটে গয়নার শোরুমে ডাকাতি করে পালানোর পর বুধবার তাকে গ্রেফতার করেছে রানাঘাট থানার পুলিশ। পুলিশ সূত্রে খবর, বিহারের বাসিন্দা কুন্দনের অপরাধের তালিকা দীর্ঘ।
মঙ্গলবার বিকেলে রানাঘাটে ডাকাতির পর পুলিশ এবং ডাকাতদলের যে ভিডিয়ো ভাইরাল হয়, তাতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হেলমেট মাথায় এক যুবককে দেখতে পাওয়া যায়। পুলিশের দাবি, সে-ই কুন্দন। কয়েক মাস আগে কয়লা ব্যবসায়ী রাজু ঝা খুনে নাম জড়ায় তার। পুলিশ সূত্রে খবর, বিহারের বৈশালীর বাসিন্দা হলেও দীর্ঘ দিন বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই কুন্দনের। বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে মন কষাকষির পর আর নাকি বাড়িমুখো হয়নি সে। তবে ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে তার এখনও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এক কয়লা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা দাবি করে কুন্দন। টাকা না মেলায় ওই ব্যবসায়ীকে খুন করে অল্প বয়সেই অপরাধ জগতে হাত পাকিয়ে ফেলা কুন্দন ১৭ বছর বয়সে বীরপুরের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও তাঁর ভাইকে গুলি করে খুন করে পালায় বলে অভিযোগ। পুলিশ তার খোঁজ শুরু করলে কুন্দন ঢুকে পড়ে বাংলায়। আসানসোলের শ্যাম সিংহের ডেরায় আশ্রয় নেয় সে। সেখান থেকে একের পর এক অপরাধের ঘটনায় নাম জড়ায় কুন্দনের।
কুন্দনের বন্দুকের নিশানা নাকি নিখুঁত। ‘প্রতিকূল পরিস্থিতিতে’ ঠান্ডা মাথায় খুন করে ফেলতে পারে সে। ১৯ বছর বয়সেই এক কয়লা ব্যবসায়ীকে খুনের অভিযোগে পুলিশের হাতে পাকড়াও হয় কুন্দন। কিন্তু জেলবন্দি থাকাকালীন একাধিক কুখ্যাত দুষ্কৃতীর ‘সান্নিধ্য’ কুন্দনকে ‘গ্যাংস্টার’ করে তোলে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে তার অবাধ কর্তৃত্ব শুরু হয়। তৈরি করে ফেলে চার চারটি দুষ্কৃতী দল। কুন্দনের দলে ১৭ থেকে ২২ বছরের ছেলেরাই অগ্রাধিকার পায়। সাত থেকে ১০ সদস্যের প্রায় ন'টি গ্যাংয়ের সর্বেসর্বা কুন্দন ডাকাতির ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ থেকে ‘এক্সিট পয়েন্ট’ পর্যন্ত পুরো পরিকল্পনা করত নিজে। কুন্দনের দলের ‘নাম’ মূলত ডাকাতি, তোলাবাজি, অপহরণ এবং ছিনতাইয়ে। আর ‘সুপারি কিলার’ হিসাবে কুন্দন কাজ করত নিজে।
রানাঘাট ডাকাতিকাণ্ডে কুন্দনের গ্রেফতারির পর তাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে বিভিন্ন জেলার পুলিশ দল। রাজ্যের একাধিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিস্তর অভিযোগ উঠছে ধৃতের বিরুদ্ধে। পুলিশ সূত্রে খবর, গাঁজা ও হেরোইনের নেশায় আসক্ত কুন্দন মূলত নেশার টাকা জোগাড় করতেই ‘শুটার’ হয়। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের একটি খুনের ঘটনায় নাম উঠে এসেছে তার। রানাঘাটকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে, কোনও জায়গায় ডাকাতির পরিকল্পনা করলে প্রায় মাসখানেক আগে সেখানে ঘাঁটি গাড়ত কুন্দনের দলবল। রেইকি করার গোটা দায়িত্ব নিজেই সামলাত কুন্দন। এ হেন অভিযুক্তকে জেরা করে বহু অপরাধের প্রেক্ষাপট জানা যাবে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এ নিয়ে রানাঘাট পুলিশ সুপার কে কান্নান বলেন, ‘‘একাধিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে কুন্দনের বিরুদ্ধে। তদন্তকারী দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সমস্ত তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা করছে।’’