প্রতীকী ছবি।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের জমিজট প্রায় কেটেই গিয়েছে। নতুন করে রাস্তা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। অথচ সেই জমিজটের কারণেই আটকে রয়েছে কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ধাম পর্যন্ত রেললাইন তৈরির কাজ। যে রেলপথ তৈরি হলে শিয়ালদহ ও বনগাঁ থেকে রানাঘাট, কৃষ্ণনগর হয়ে ভাগীরথী নদী পার হয়ে নবদ্বীপ ধাম স্টেশন মারফত সরাসরি উত্তরবঙ্গে যাওয়ার পথ খুলে যাবে।
এই রেললাইন পাতার জন্য একাধিক বার জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শুরু না হওয়ায় সেই বিজ্ঞপ্তি বাতিল হয়ে গিয়েছে। ফলে গোটা প্রকল্পই কার্যত চলে গিয়েছে বিশ বাঁও জলে। জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া আবার কবে শুরু হবে তা-ও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ।
রেল ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি শান্তিপুর থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত ন্যারোগেজ রেল পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। তার কয়েক দিন আগেই, তদানীন্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি এই ন্যারোগেজ লাইনকে ব্রডগেজ করার প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। প্রায় ২৭ কিলোমিটার লাইনের জন্য রেল বাজেটে অর্থ বরাদ্দও করা হয়। রেল সূত্রের খবর, শান্তিপুর থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি টাকা ও কৃষ্ণনগর থেকে স্বরূপনগরের নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত অংশের জন্য প্রায় ৮১ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় অংশে অনেকগুলি ছোট সেতু ও অন্য পরিকাঠানো তৈরি করতে হবে বলে খরচটাও বেশি। ঠিক হয়, নবদ্বীপে ভাগীরথীর উপরে রেলসেতু তৈরি হবে। তার উপর দিয়ে রেললাইন গিয়ে মিশবে নবদ্বীপ ধাম স্টেশনে। নবদ্বীপ ঘাট থেকে রেলসেতু পর্যন্ত ৯.৫৮ কিলোমিটার লাইনের জন্য প্রায় ২৫০.৮৩ কোটি টাকা ও ভাগীরথীর উপরে রেলসেতুর জন্য ৯০.৬২ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছিল।
সেই মতো শান্তিপুর থেকে কাজও শুরু হয়। কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ব্রডগেজের কাজ শেষ করে কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত কাজ শুরু হয়। কিন্তু এই পথেই ফকিরতলার কাছে রেলকে প্রথম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নানা কারণে ওই এলাকার জমি দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি ওঠায় আমঘাটা পর্যন্ত রেললাইন তৈরি হয়ে
প্রকল্প থমকে যায়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নানা ভাবে চেষ্টা করেও ওই এলাকায় জমিজট না খোলায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে রেল নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত লাইন না নিয়ে গিয়ে তার আগেই ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। ঠিক হয়, স্বরূপগঞ্জের নবদ্বীপ ঘাট থেকে নয়, এই এক্সপ্রেসওয়ে তেওরখালি মৌজা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে গিয়ে উঠবে রেলসেতুর কাছে। ঠিক হয়, মহেশগঞ্জ স্টেশন ও বড় মসজিদের মাঝখানের এলাকা দিয়ে তেওরখালি মৌজার উপরে বাঁ দিক দিয়ে ঢুকবে রেল লাইন। তার পর গাদিগাছা, মাইজদিয়া, উশিতপুর, ব্রহ্মনগর, পারমেদিয়া, গৎখালি ও তেঘরি মৌজার উপর দিয়ে তৈরি হবে নতুন রেলপথ।
প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা যায়, এই নতুন লাইনের দৈর্ঘ্য হবে ১২.১৬৯ কিলোমিটার। তার জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ২৬৪ একর জমি। ৮৬১ দাগ জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হবে। এই নতুন লাইন তৈরি হবে কৃষ্ণনগর ১ ও নবদ্বীপ ব্লকের উপর দিয়ে। সেই মতো ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জেলা প্রশাসনের তরফে রেলওয়ে আইন ১৯৮৯ অনুযায়ী জমি অধিগ্রণের জন্য ‘গেজেট নোটিফিকেশন’ জারি করা হয়। ওই আইন অনুযায়ী, এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু এখানেও বাধার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে তেওরখালি এলাকার লোকজন আপত্তি জানাতে থাকেন। বিকল্প পথ হিসাবে ভকতপাড়ার কথাও বলতে থাকেন অনেকে।
এই টানাপড়েনের মধ্যে কেটে যায় একটা বছর। ফলে প্রথম বারের জারি করা বিজ্ঞপ্তি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আবার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু এ বারও সেই একই অবস্থা। স্থানীয়দের পাশাপাশি জড়িয়ে যান রাজনৈতিক দলের নেতারাও। এ বারও সময়সীমা পার হয়ে যেতে থাকে। জেলা প্রশাসনের তরফে নতুন করে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। তেওরখালি এলাকায় যখন বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে, তখন সেতুর দিক থেকেই অধিগ্রণের কাজ শুরুর কথা ভাবা হয়।
সেই মতো অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি রাজস্ব) নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাসের নেতৃত্বে জমি অধিগ্রহণের একটি দল ২০১৮ সালের নভেম্বরে হাজির হন গৎখালি এলাকায়। সেখানে প্রায় ৩০০ মিটার মতো অধিগ্রহণের কাজ হওয়ার পরে আবার স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা দেন। জেলা প্রশাসনের লোকজনকে ফিরে যেতে হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করেও কোনও লাভ হয়নি।
জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা সব রকম চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু নানানকারণে স্থানীয় মানুষ বেঁকে বসেন। তাঁদের কাছে ক্ষতিপূরণের চেয়েও অন্য বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েও সেই জট খোলা যায়নি।”
এ ভাবে ফের এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও কাজ শুরু করতে না পারায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সাতটি মৌজায় জারি হওয়া বিজ্ঞপ্তি ফের বাতিল হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে, এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় গৎখালি মৌজার জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াও বাতিল হয়েছে। ফলে এই জমি অধিগ্রহণ করে কাজ শুরু করতে গেলে আবারও নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে।
জেলার জমি অধিগ্রহণ দফতরের এক কর্তার কথায়, “যত দূর জানি, এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে রাজ্যস্তরে রেলের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়েছে।”
তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব শেষ হোক নতুন রেললাইন তৈরির কাজ। চরস্বরূপগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা অশোক দাসেরা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন, স্বরূপগঞ্জ পর্যন্তই নিয়ে আসা হোক রেললাইন। তার পরে না হয় বাঁ দিকে বেঁকে রেলসেতুর উপর দিয়ে গিয়ে নবদ্বীপ ধাম স্টেশনে যাক। তবে নানা জটিলতার কথা মাথায় রেখে এখন তাঁরা বলছেন, “আমরা চাই, স্বরূপগঞ্জে নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত লোকাল ট্রেন চালানোর জন্য লাইনটা তৈরি হোক। পাশাপাশি, ভাগীরথী পার হয়ে এক্সপ্রেস ট্রেন যাওয়ার জন্য রেললাইন তৈরি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করুক রেল ও জেলা প্রশাসন। সবাই চাইছে, যেটাই হোক দ্রুত হোক।”