কাশীকান্ত মৈত্র
এক বিরল প্রকৃতির বাঙালি রাজনৈতিক নেতা কাশীকান্ত মৈত্র চলে গেলেন। কিন্তু মানুষটির সে ভাবে মূল্যায়ন হল না।
কৃষ্ণনগরকে কেন্দ্রে করে রাজনৈতিক বৃত্তে উঠে আসা কাশীকান্তের প্রধান কাজ ছিল মানুষের দুঃখে পাশে দাঁড়ানো। আইনজীবী হিসেবে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বহু দরিদ্র বিচারপ্রার্থীকে সাহায্য করেছেন। ’৬৬ সালে কৃষ্ণনগরে খাদ্য আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন কাশীকান্ত। তিনি তখন কৃষ্ণনগরের বিধায়ক। চালের দাম বেড়ে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। চাল ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে চাল গুদামজাত করেন। তখন কাশীকান্তবাবু সেই চাল উদ্ধার করে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করেন এবং সমস্ত অর্থ চালের মালিকদের হাতে তুলে দেন।
রাজনীতিতে এমন পরিচ্ছন্ন মানুষ বিরল। ১৯৭৪ সালে খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে কাশীকান্তের দফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং ঘোষণা করেন যে তাঁর বিরুদ্ধে এক পয়সার দুর্নীতি প্রমাণ হলে তিনি রাজনীতি চিরতরে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ মুখ্যমন্ত্রী গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন।
কাশীকান্ত বলতেন, রাজনীতি সমাজসেবার অঙ্গ। সেখানে সেবাধর্মই শেষ কথা। তাই অবসরের পর সরকারি নিয়ম অনুসারে বিধায়কদের পেনশন পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। কুড়ি বছর বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও তিনি পেনশন গ্রহণ করেননি। সারা ভারতে এ নজির অনন্য। ১৯৬৮ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্টের কয়েক জন বিধায়ক পদত্যাগ করলে অজয় মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভা পতনের মুখে পড়ে।। রাজ্যপাল ধর্মবীর মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অজয়বাবু ও জ্যোতিবাবুর নেতৃত্বে কয়েক জন মন্ত্রী রাজভবনে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যান। কাশীকান্ত ছিলেন সেই দলের অন্যতম সদস্য। সংবিধানের কূটযুক্তিতে কাশীবাবু রাজ্যপালকে কাবু করে দেন। বাধ্য হয়ে রাজ্যপাল বলেন, “আমি সংবিধানের ছাত্র নই।”
বিশিষ্ট বাগ্মী কাশীকান্ত ছিলেন মানবিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক, মননশীল ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও করোনা মোকাবিলায় কয়েক লক্ষ টাকা দান করে গিয়েছেন। নদিয়া জেলার বহু দরিদ্র মানুষকে লোকচক্ষুর আড়ালে মাসিক ভাতা দিতেন। কল্যাণীতে ক্ষুদ্র শিল্পের আওতায় স্কুটার কারখানা স্থাপন করেছিলেন। জেলায় জেলায় দুগ্ধ সংগ্রহকে কেন্দ্র করে দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের আয় বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে দণ্ডকারণ্য থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তুদের বসবাসের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের বিরোধিতার বিরুদ্ধে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হিসেবে গর্জে উঠেছিলেন তিনি। উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। এর জন্য তাঁকে কারাবরণও করতে হয়।
ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণার সমর্থনে রাজ্য বিধানসভায় এক প্রস্তাব আনা হয়েছিল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। সারা রাজ্যে তখন এক ভীতির পরিবেশ। কাশীকান্ত তখন কংগ্রেস থেকে সাসপেন্ড হওয়া বিধায়ক। তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসেন। তিনিই একমাত্র বিধায়ক যিনি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বিধানসভায় দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করেন, যা সারা ভারতে গণতন্ত্র ও সংবিধানের আদর্শকে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। ৬০ বছর ধরে আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সেই জায়গা থেকেই বলতে পারি, তাঁর প্রয়াণে এক মূল্যবান রত্নকে হারাল দেশ।
(লেখক রাজনৈতিক কর্মী তথা নদিয়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান)