দিন ছোট হয়ে এসেছে। টুপ করে পাটে যাচ্ছে সুয্যি। সপরিবার দুগ্গা ছলছল চোখে কৈলাসে ফিরে গিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ‘আজ আমাদের লক্ষ্মীপুজো, দাও গো দু’টো ভাজাভুজো’ বলতে বলতে গলা ভেঙেছে খুদের দল। শুধু পড়ন্ত বিকেল মাঝেমধ্যে মনে পড়িয়ে দেয়, পুজোর ছুটি শেষ হতে চলল। পড়ে আছে হাতের লেখা। মুখস্থ হয়নি ‘এসেছে শরৎ, হিমের পরশ’। নয়ানজুলির দু’ধারে তখনও জেগে কাশফুল। মাথা দুলিয়ে অভয় দেয়, ‘ভয় কী রে! সামনে এখনও কালীপুজো, ভাইফোঁটা। তার পরে না স্কুল খুলবে!’ গুমোট মনকেমন উধাও। মাথার ভিতরে ফের শরতের রোদ্দুর।
ক’দিন পরেই অমাবস্যা। কালীপুজো। পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপে চলছে ‘মিটিং’। বাড়িতে বাড়িতে প্রদীপ, সলতে তৈরির ধুম। দুর্গাপুজোর নাড়ু-মুড়কি শেষ। ফের তৈরি হচ্ছে ঝুড়ি, মুড়ি, নারকেল, তিলের নাড়ু। পাড়ার দোকানে লিকলিকে মোমবাতির ভিড়। বেশিরভাগ বাড়িতে কালীপুজোর রাতে প্রদীপই জ্বলত। খুদেদের আবদারে আনা হতো দু’-এক প্যাকেট মোমবাতি। শব্দবাজি নিয়ে এত চোর-পুলিশ খেলা তখন শুরু হয়নি। বুড়িমা-স্টার-দুলালের চকোলেট, কালীপটকা, হাউই, রংমশাল, দোদোমা, তুবড়ি। তবে বাজি নিয়ে এখনকার প্রশাসন কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদের থেকেও বেশি কড়া ছিলেন অভিভাবকেরা। তাঁদের নজর এড়িয়ে যারা হাতেই ফাটাত বুড়িমা কিংবা কালীপটকা, তারাই তখন আমাদের চোখে ‘বিগ বি’।
সবার বাড়িতে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। সন্ধ্যার পরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কালীপুজোর আগে ভূত চতুর্দশী। ভূত! সূর্যাস্তের পরে এই একটি শব্দ যে কী ভাবে মাথা ও মনের ভিতরে ডালপালা মেলত সে-ও এক বিস্ময়! কিন্তু মা তো সব জানে! এমনকী ভূতের মন্তরও। তা-ও আবার নির্ভেজাল চলিত বাংলায়। ভূত চতুর্দশীর রাতে বাড়ির বাইরে বেরোনোর সময় শিখিয়ে দেওয়া হতো সেই মন্তর, ‘ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি/রাম-লক্ষ্ণণ বুকে আছে করবি আমার কী!’
ঘুটঘুটে রাতে বেলতলা, পথের পাশে বাঁশবাগান দিয়ে যাওয়ার সময় নাগাড়ে সেই মন্তর আউরেও গায়ে কেমন কাঁটা দিত। মনে হতো, কেউ যেন পিছু নিয়েছে। অথচ ভয়ে সে দিকে তাকানোর উপায় নেই। পিছনে তাকালেই যদি ঘাড় মটকে দেয়! সামনের গাছের ডালে ওটা কী ঝুলছে? লিকলিকে ঠ্যাঙের মতো। ঠিক সেই সময়েই মনে পড়ত যত রাজ্যের ভূতের গল্প। বনমালি জেঠুর মুখে শোনা ‘বেম্মদত্যি, গোদানো, শাঁকচুন্নি’-র দলও যেন পিছু নিত। অগত্যা দৌড়। মন্ত্রের থেকেও যা কিছু কম যেত না। শেষতক বাড়ি পৌঁছে হাঁফাতে হাঁফাতে মনে হতো, ‘করবি আমার কী’ বলে ও ভাবে ভূতেদের চ্যালেঞ্জ না জানানোই ভাল। তেনারা কিছু করেননি বটে। কিন্তু ভয় যে দেখাবে না সে কথা তো মন্তরে বলা নেই!
ভূত চতুর্দশীর পরের দিন কালীপুজো। বিকেল থেকেই শুরু হতো তোড়জোড়। সকলেই বাড়ির ছাদে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। মা-ঠাকুমারা নিজেদের তৈরি প্রদীপে তেল-সলতে ভরে ঠিক করে রাখতেন। খুদেরা লম্ফঝম্প বন্ধ করে লক্ষ্মী ছেলের মতো লম্ফ হাতে মোমবাতি বসাত ছাদের ধারে। যাঁদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল, তাঁদের কেউ কেউ কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন টুনি-বাল্ব। কালীপুজোর রাতে সে বাহারি বাল্ব দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। তবে বিদ্যুতের বিলের কথা মাথায় রেখে সে বাল্ব অবশ্য বেশি রাত পর্যন্ত জ্বলত না। কিন্তু প্রদীপ ও মোমবাতি সাজানোও যে একটা ‘আর্ট’ তা দেখিয়ে দিত গাঁয়ের অনেকে। ন্যাড়া ছাদ, পাঁচিল, চিলেকোঠার উপরে দারুণ করে সাজানো হতো নরম সেই আলো।
এক বার এমনই কালীপুজোর রাতে গোটা পাড়া অবাক হয়ে গিয়েছিল। সকলের বাড়িতে জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে গিয়েছে মোমবাতি। নিভে গিয়েছে প্রদীপ। অথচ আমাদের বাড়ির ছাদে ভোররাত পর্যন্ত নাকি মোমবাতি জ্বলতে দেখা গিয়েছে। কী করে হয়? অমন লিকলিকে মোমবাতির অত দম থাকে নাকি? শেষ পর্যন্ত ছাদে উঠে দেখা গেল, ছাদের ধারে গলে যাওয়া মোমবাতির পাশে ক্লাসের গোঁজ হয়ে বসে রয়েছে সেই লম্ফ। নেভাতে খেয়াল ছিল না। যতক্ষণ কেরোসিন ছিল, ততক্ষণ জ্বলেছে। কী জ্বালা!
আর ছিল আমাদের তৈরি টর্চ। কালীপুজোর রাতে সেই টর্চ ছাড়া কেউ ঠাকুর দেখতে বেরোতাম না। বাড়িতেই পড়ে থাকত নারকেলের মালা (মুর্শিদাবাদের বহু গ্রামে অবশ্য ‘মালুই’ বলা হয়)। সেটাকে ভাল করে পরিষ্কার করে, শুকোনো হতো। তার পর শক্ত দেখে একটা পাটকাঠি ভেঙে সেই মালায় গুঁজে দেওয়া হতো। হয়ে গেল হাতল। এ বার মোমবাতি জ্বালিয়ে বসিয়ে দেওয়া হত সেই মালায়। হয়ে গেল টর্চ। অমাবস্যার রাতে মেঠো রাস্তা ধরে এমন অজস্র টর্চ ঘুরে বেড়াত। দূর দেখে দেখলে মনে হতো, যেন আঁধার মোছার পণ করে হেঁটে চলেছে আলোর মিছিল। অন্ধকার দূর করতে আজও সবাই মরিয়া। ভূত মানে যে অতীত তা জেনেছি অনেক পরে। কংক্রিটের শহরে, এলইডি-র রোশনাইয়েও ভাগ্যিস সেই ভূতেরা ফিরে ফিরে আসে!
অঙ্কন: অর্ঘ্য মান্না