পদ্মার শাখানদী জলঙ্গির দৈর্ঘ্য ২২০.৫ কিলোমিটার। তার মধ্যে প্রায় ২৮ কিলোমিটারের আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কোথাও নদী এখন আবাদি জমি, রাজ্য সড়ক, কোথাও আবার ‘ডাস্টবিন’। উৎসমুখও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছবিটি তোলা হয়েছে কৃষ্ণনগরে।
১৮৭২ সাল। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘লোকরহস্যে’ লিখলেন, ‘... যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন তিনিই বাবু”।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষ আসলে নদীকে কী চোখে দেখেন, তা নিয়ে এমন নির্মম বিদ্রূপের পরেও গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে বহু জল। এখনও নিয়ম করে প্রতি বছর দশহারা তিথিতে সাড়ম্বরে গঙ্গা পুজো হয়। সারাটা বছর ধরে নদী হত্যার পাপ ধুয়ে ফেলতে মানুষ চিরকালই স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানের উপরই ভরসা রেখেছে।
স্মার্ত মতে, জ্যৈষ্ঠের শুক্লা দশমীতে গঙ্গাস্নানে দশবিধ পাপের মুক্তি ঘটে। পুরাণ মতে, ওই দিনই নাকি ভগীরথ মহাদেবের জটাবন্দি গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন। তাই ওই দিন তিনি আরাধ্যা দেবী। সেই কবে থেকে কৃষি-সহ সভ্যতার নানা প্রয়োজনে মানুষ প্রবহমান জলধারাকে খাল কেটে নিয়ে আসছে লোকালয়ে। কাহিনির পৌরাণিক খোলসটি ছাড়ালে বর্ষার প্রাক্কালে দশহারার এই তাৎপর্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রমাণ হয়, নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আসলে প্রয়োজনের।
পুজোর ছলে ভুলে থাকায় অভ্যস্ত নদীপাড়ের মানুষ নদীপুজোর হট্টগোলে নদীটারই খোঁজ রাখে না। তাই ‘লোকরহস্য’ রচনার দেড়শো বছর পরে ‘ধনপতির সিংহল যাত্রা’ বইয়ে রামকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন নদী উপেক্ষার আখ্যান, ‘...হারিয়ে যায় একজনা, একটি কুমারী অলকানন্দা। দু-কুলের পাখি সুর হারায়, দু-পাড়ের বন স্বর হারায়, দু-তীরের দেবালয় মন্ত্রধ্বনি হারায়, দু-পাশের জনপদ গীত হারায়। কেউ বলে অলকানন্দা এখন হিমালয়বাসী, কেউ বলে দেবলোকের বাসিন্দা। অলকানন্দা হারিয়েছে, কিন্তু গাঙ্গনি-খড়িয়া-জলঙ্গি হারাতে চায় না জনপদবাসী।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নদী কি বাঁচে? পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম যখন চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন তখন থেকেই নদীদের হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে গঙ্গার প্রবাহপথের আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের সময় নদী হারানোর শুরু। গঙ্গা-পদ্মার মতো অসংখ্য নদী মৃত্যুর দিন গুনছে যতটা না প্রাকৃতিক কারণে, তার থেকে ঢের বেশি মানুষের লোভের জন্য।
মোট ২২০.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জলঙ্গির এখন অস্তিত্ব রয়েছে ১৯২.৫ কিলোমিটারের। কান্দিতে কানা ময়ূরাক্ষীর ‘কাঁদরের’ উপর সেতুর বদলে কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। ডোমকলে গুমানি নদীর বুকে মাটি ফেলে রাস্তা করেছে পঞ্চায়েত। কানা ময়ূরাক্ষী নদীর উপর কান্দি-কুলি ব্রিজ সংস্কারের সময় মাটি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে নদীর বুক। কেউ নদীর বুকে মাটি ফেলে আবাদি জমি বাড়িয়েছেন। কেউ লরি লরি মাটি ফেলে নদীর দু’পাড়কে কাছে এনে পারাপারের সুবিধা করেছেন। মৎস্য সমবায়গুলি লিজের নামে নদীকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে। এ সব কথা সবাই জানে। কিন্তু এ নিয়ে কেউই বিশেষ মাথা ঘামান না।
খোদ রাজা যদি নদী হত্যায় মদত দেন, প্রজারা আর কী-ই বা করতে পারে! সপ্তদশ শতকে জলঙ্গির একটি শাখা, অঞ্জনা কৃষ্ণনগর থেকে বেরিয়ে দোগাছিতে দু’টি ধারায় বিভক্ত হত। দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত (১৮৫৭) বইযে অঞ্জনার কথা পাওয়া যায় বিশদ ভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন ১৬৮৪ সালে রাজা রুদ্র রায় নদীর উৎসমুখটি বন্ধ করে দেওয়ার পর নদীটি মজে যায়। ১৬৮৪ থেকে ২০১৮। নদীহত্যার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।