সোনায় মোড়া ‘ছোটমা’ নামে পরিচিত কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। — নিজস্ব চিত্র
ঠাকুরের কাছে ভক্তের প্রণামী। সেই সূত্র ধরেই প্রায় প্রতি বার কৃষ্ণনগর হয়ে ওঠে ‘কাঞ্চননগর’।
কথিত আছে, কৃষ্ণনগরের একাধিক জগদ্ধাত্রী পুজোর কয়েকটি ‘জাগ্রত’। ফলে সেই পুজোয় ভক্তের ভিড়ও দেখার মতো। ফলে ওই সব পুজোগুলিতে প্রার্থনা এবং মানতের পরিমাণও আড়েবহরে ভালই। প্রতি বার কৃষ্ণনগরের বুড়িমা, ছোটমা , আদিমা, মেজমা-সহ বহু জগদ্ধাত্রী প্রতিমার কাছে মনোবাঞ্চা পূর্ণ হলে স্বর্ণালঙ্কার দেওয়ার মানত করেন সহস্রাধিক মানুষ। এমনটাই দীর্ঘ দিনের রীতি। ভক্তদের অনেকেই প্রণামী হিসাবে দেন সোনার টিপ, টিকলি, নথ, হার, চুড়ি ইত্যাদির মতো গয়না। স্বর্ণালঙ্কার প্রাপ্তিতে প্রথম স্থানে রয়েছে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো, যা বুড়িমা হিসাবে সুপরিচিত। বর্তমান বুড়িমার স্বর্ণালঙ্কারের পরিমাণ প্রায় ৯ কিলোগ্রাম। বর্তমানে প্রায় ৮০০ ভরি অলঙ্কারের মালিক বুড়িমা। প্রতি বার সেই স্বর্ণ ভান্ডার আকারে বেড়ে চলেছে। প্রতিমার নামে কী কী অলঙ্কার আছে সেই তথ্য রাখা হয় কম্পিউটারে। প্রতিমার বাহনও সোনায় মোড়া। বুড়িমা পুজো কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘গত বছর পর্যন্ত মোট সোনার পরিমাণ ছিল ৭ কিলোগ্রামের কাছাকাছি। এ বার সেই পরিমাণ অনেকটাই বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।’’
স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিতা কৃষ্ণনগরের অন্যতম জগদ্ধাত্রী প্রতিমা ‘বুড়িমা’। — নিজস্ব চিত্র
বুড়িমার মতো এত অলঙ্কার না পেলেও বহরে কম নয় ছোটমা বা জলেশ্বরী মায়ের স্বর্ণালঙ্কারের ভান্ডার। এ ছাড়াও রয়েছে কাঁঠালপোতার ছোটমা, মালোপাড়ার জলেশ্বরী, চকেরপড়ার আদিমার মতো জগদ্ধাত্রী পুজোগুলি। তাদের স্বর্ণসম্ভারও তাক লাগানোর মতো। প্রতিবার এক একটি প্রতিমাকে সাজানো হয় কয়েক’শো ভরি সোনার অলঙ্কার দিয়ে। চকেরপাড়ার আদিমা পুজো কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা জয়ন্ত ঘোষ বলেন, ‘‘নিরাপত্তার কারণে মোট অলঙ্কারের পরিমাণটা না বলতে পারলেও, বেশ কয়েক কিলোগ্রাম সোনা আছে। তবে এ বার ভক্তদের মানতের বহর চোখে পড়ার মতো।’’
এ বার মানতের স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করতে হিমশিম খেয়েছেন কৃষ্ণনগর এবং তার আশপাশের এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। জগদ্ধাত্রী পুজোর সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই গয়নার দোকানে ভিড় বাড়ছিল ভক্তদের। কৃষ্ণনগরে ছোটবড় মিলিয়ে ৬০-৭০টি সোনার দোকান রয়েছে। এ বারের জগদ্ধাত্রী পুজোর মানতের হিড়িকে গত কয়েক দিনে গয়নার কেনার যে ধুম পড়েছিল তাতে সবমিলিয়ে প্রায় কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে বলে দাবি করেছেন কৃষ্ণনগর ব্যবসায়িক সংগঠনের সম্পাদক গোকুলচন্দ্র সাহা। শহরের বউবাজার অঞ্চলের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আকাশ স্বর্ণকার বলেন, ‘‘শুধুমাত্র পুজোর আগের দিন সোনার নথ, টিকলি এবং টিপ বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ টাকারপ। অন্যান্য অলঙ্কার ধরলে টাকার অঙ্কটা ২০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে।’’
‘মেজমা’ হিসাবে পরিচিত কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। — নিজস্ব চিত্র
সারা বাংলা স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ী সমিতির তরফে নির্মল কর্মকারের মতে, অতিমারির জেরে গত কয়েক বছর ভক্তরা সে ভাবে মানত করতে পারেননি। তাঁর মতে, এ বার করোনা পর্বের বিধিনিষেধ না থাকায় এবং সোনার দাম কিছুটা কমায় বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ।
কৃষ্ণনগরের প্রায় ২০টি সাবেকি পুজোর বিপুল অলঙ্কার ভান্ডার পাহারা দেওয়ার ভার প্রশাসনের কাঁধে। প্রতিমাকে সোনার সাজ পরানো থেকে বিসর্জনের আগে তা খুলে ব্যাঙ্কের লকারে ফিরিয়ে দেওয়া ইস্তক, নিরাপত্তার দায়িত্ব জেলা পুলিশের উপর। ভালয় ভালয় পুজো মিটে যাওয়ায় স্বস্তিতে কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশ বাহিনী। বাস্তবের ‘এল ডোরাডো’র ইতিবৃত্ত শুনে প্রবীণ কৃষ্ণনাগরিক রবি সাহার রসিকতা, ‘‘কে জানে পুলিশকর্তাদের কেউ কেউ হয়তো মানত করেছেন, ‘‘সব কিছু ঠিকঠাক উতরে দাও মা, তোমাকে সোনার হার দেব!’’’’