দোল ফুরিয়েছে অনেক আগেই। চৈত্রও ফুরলো বলে। বাতাসে আবির রয়ে গিয়েছে একটাই জায়গায়।
রানাঘাট দক্ষিণে— কতটা পাকা সেই আবিরের রঙ?
কোন আবির?
শ্রীআবীররঞ্জন বিশ্বাস। এক সময়ে তামাম নদিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় নেতা আনন্দমোহন বিশ্বাসের ছেলে।
কিন্তু আবির উড়ছে যে হাওয়ায়, সেই হাওয়া ঘুরছে। বল স্যুইং করছে মারাত্মক। শেষে ব্যাটের কানায় চুমু দিয়ে গ্লাভসে গিয়ে না জমে!
বল কার হাতে?
‘‘সিপিএমের রমা বিশ্বাস’’— নিশ্চিত আবির।
উইকেটের পিছনে কে? গ্লাভসের নীচে ছুরি লুকনো নেই তো?
একটু চুপ। বুঝেছেন প্রশ্নটা।
বল স্যুইং করছে।
লম্বা শ্বাস টেনে আবীর বলছেন— ‘‘দলে যারা আমার বিরোধিতা করছে, তারা যে কতটা আপ্রাসঙ্গিক, মানুষই বুঝিয়ে দেবে। ঘাসফুলের ওজন ওরা এখনও করে উঠতে পারেনি।’’
মুখে যতই হম্বিতম্বি করুন, আবীর জানেন, তাঁর তিনটে স্টাম্পই নড়বড়ে।
প্রথমত, ভোটের পাটিগণিত তাঁর পক্ষে যাচ্ছে না।
গত পঞ্চায়েত ভোটে এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রায় ২১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। লোকসভা ভোটেও তাদের প্রাপ্ত ভোট নেহাত কম নয়। প্রায় ১১ শতাংশ। বামফ্রন্ট পেয়েছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ, তৃণমূল ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, পঞ্চায়েত ও লোকসভা, দুই ভোটেই সিপিএম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট তৃণমূলের চেয়ে বেশি।
বাকি থাকল বিজেপির বাক্সে থাকা ভোট। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিধানসভা ভোটের থেকেও কমে বিজেপি দাঁড়ায় মোটে ২ শতাংশে। অথচ পরের বছর লাফিয়ে ওঠে ১৯ শতাংশে। কোথা থেকে এল এই ভোট? সিপিএম একাই পঞ্চায়েত ভোটের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ ভোট খুইয়েছিল। বাকি ১০ শতাংশ খুইয়েছিল কংগ্রেস। অর্থাৎ, পুরো ১৭ শতাংশই বিজেপি পায় অ-তৃণমূল ভোটব্যাঙ্ক থেকে। বিজেপি যদি সেই ভোট ধরে রাখতে না পারে তবে তা নিজের ঘরেই ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি তা সত্যি হয়, আবীর শুধু হারবেনই না, বাজে ভাবে হারবেন।
দ্বিতীয়ত, শঙ্কর-ফ্যাক্টর।
শীতঘুম ভেঙে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নামা শঙ্কর সিংহের ভাল প্রভাব এই কেন্দ্রে। তাঁর খাসতালুক কুপার্স ক্যাম্পও এই কেন্দ্রেই। ২০১২ সালের কুপার্সের ভোটে একা দাঁড়িয়ে থেকে লড়েছিলেন শঙ্কর। এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তৃণমূলের বাকি প্রায় সব তাবড় নেতা এসেও একটার বেশি আসন জেতাতে পারেননি। ১২ আসনের মধ্যে ১১টিতেই কংগ্রেস জেতে। শঙ্কর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য সকলেই তৃণমূলে যোগ দেন। এ বার জোটের হাওয়ায় তাঁরা কোন দিকে ঢলবেন, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।
এর উপরে আছে উইকেটকিপার। গ্লাভসে লুকনো ছুরি।
চেনা কথায়, বিরোধী গোষ্ঠী।
বাতাসে আপাতত ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু নাম। যেমন রানাঘাট ২ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি জগদীশ মণ্ডল, আনুলিয়া অঞ্চলের প্রাক্তন সভাপতি ভীম কোলে, জেলা টিএমসিপির সভাপতি ও জেলা যুব তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি জয়ন্ত পাল। জেলা পরিষদ সভাধিপতি বাণীকুমার রায়ের ঘনিষ্ঠ কিছু নেতার নামও শোনা যাচ্ছে।
গত বার আবীর যখন জেতেন, তৃণমূলের রানাঘাট ১ ব্লক তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন তাপস ঘোষ। রানাঘাট ২ ব্লকের সভাপতি ছিলেন রানাঘাট (উত্তর-পূর্ব) কেন্দ্রের বিধায়ক সমীর পোদ্দার। বিধায়ক হওয়ার পরে নিজের কেন্দ্রে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন আবীর। তখনই বিরোধ বাধে তাপস-সমীরের সঙ্গে। পরে মুকুল-ঘনিষ্ঠ তকমা দিয়ে পদ থেকে তাপস-সমীরকে সরিয়ে দিয়েছিলেন জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। তাতে আবীরের সঙ্গে ওই দু’জনের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। যদিও এখন সমীর প্রকাশ্যে প্রার্থীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তবে তাঁরা অনুগামীদের বিশেষ দেখা যাচ্ছে না।
ভোটপ্রচারের ময়দানে চোখ-কান খোলা রাখলেই ছবিটা অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
মাঝেরগ্রাম বাজারে সন্ধ্যা নেমেছে। টেলিফোনের পোস্টে বাঁধা চোঙ। প্রধান বক্তা প্রার্থী নিজে। কিন্তু সে দিন পঞ্চায়েত ভোটেও যাঁরা জান দিয়ে তাঁর জন্য লড়েছিলেন, দলের সেই সব কর্মীরা কোথায়? সভাস্থল থেকে খানিক দূরে চপের দোকানের ভিতরে সেঁধিয়ে ছিলেন এমনই এক তৃণমূল কর্মী। হঠাৎ তাঁর মোবাইল বেজে ওঠে। ও প্রান্ত জানতে চায়, ‘‘ভিড় কেমন?’’ এ প্রান্ত উত্তর দেয়, ‘‘ফাঁকা।’’ ভেসে আসে— ‘‘যাক!’’ লাইন কেটে যায়।
কার লাইন যে কে কাটছেন সেটাই এখন বোঝা মুশকিল। ভেবেও বুঝে ওঠা শক্ত। আবীর তাই ভাবা ছেড়ে দিয়েছেন। খালি মরিয়া হয়ে দৌড়ে চলেছেন সকাল-বিকেল। দিনে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোনোর সময় পাচ্ছেন না। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছেন হুডখোলা গাড়িতে। সন্ধ্যায় মোড়ে-মোড়ে সভা। গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার নেতার সঙ্গে বৈঠক। কোনও কিছুতে যেন ফাঁক না থাকে।
শঙ্কর সিংহও কিন্তু বসে নেই। নিজের কেন্দ্রে প্রচারের পাশাপাশি এই কেন্দ্রেও একের পর এক সভা করে যাচ্ছেন শঙ্কর। কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তিনি নিশ্চিত, ‘‘আমাদের কর্মীরা এবং ভোটারেরা জোটপ্রার্থীকে জেতাতে সব রকম ভাবে তৈরি।’’
মিছিলে-মিটিংয়ে তেরঙ্গা পতাকার ভিড় তা বুঝিয়েও দিচ্ছে। সিপিএমের প্রার্থী, জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি রমা বিশ্বাস দলের রাজ্য কমিটির সদস্য। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও বটে। গত বিধানসভা ভোটে কৃষ্ণনগর (দক্ষিণ) কেন্দ্রে উজ্জ্বল বিশ্বাসের কাছে পরাজিত হলেও ভোটটা তিনি ভালই বোঝেন। কংগ্রেসকে সঙ্গে পেয়ে তিনি উজ্জীবিত। রোজই হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক গ্রাম। বক্তৃতা করে চলেছেন একের পর এক সভায়। দুপুর রোদে পিচের রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে তিনি বলছেন, ‘‘একটা গোটা দল ডুবে আছে দুর্নীতির কাদায়। সেটাই কি তাদের প্রত্যাখ্যান করার পক্ষে যথেষ্ট নয়?’’
বৈশাখের আগেই অকাল-রোদে পুড়ছে মাঠঘাট।
আবিরের সময় কি ফুরোলো?
(সহ-প্রতিবেদন: সৌমিত্র সিকদার)