রাস্তার পাশে শুকোতে দেওয়া হয়েছে বাজি। কল্যাণীতে। নিজস্ব চিত্র।
সরু রাস্তার দু’পাশে পর পর দোকান। কতগুলো পাকা ঘর, বাকি সব অস্থায়ী ছাউনি।
কল্যাণীর শহিদপল্লি-চর কাঁচরাপাড়ায় মহালয়ার আগে থেকে বাজির বাজার বসে গিয়েছে, চলবে কালীপুজো পেরিয়ে ছট পর্যন্ত। আদালত যতই পরিবেশবান্ধব ‘সবুজ বাজি’ বাদে অন্য সব বাজির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করুক, সেই নিষেধ এই পল্লি পর্যন্ত পৌঁছয় না।
তবে শুধু কল্যাণী নয়, ঢালাও নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি হচ্ছে দুর্গাপুর থেকে কুলটি-আসানসোল। শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে শুরু করে নানা জায়গায় প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে হরেক রকম বাজি, যার মধ্যে সবুজ বাজি প্রায় নেই।
সম্প্রতি এক সকালে কল্যাণীর বাজি বাজারে গিয়ে দেখা গেল, বস্তায় ঢেলে শব্দবাজি বিক্রি হচ্ছে। রাস্তার উপর ছড়িয়ে মেশানো হচ্ছে তুবড়ির মশলা। রাস্তাতেই রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে ঢালাও বাজি। একটি ঘরের অল্প খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে মেঝেয় ঢেলে রাখা প্রচুর শব্দবাজি, যেগুলি বিক্রি হচ্ছে 'ডিলাক্স বোম' নামে। সাধারণ চকলেট বোমের থেকে বড়, শব্দও অনেক বেশি।
সকালে বউনির সময়ে খরিদ্দার পেয়ে এক দোকানি চটপট দাম জানিয়ে দেন— ২৫-৩০ পিস আলু বোম ধরনের বাজির প্যাকেট ৬৫ টাকা। কালো রঙের ১০টি ডিলাক্স বোমের প্যাকেটও তা-ই। একটু বড় প্যাকেটে সোনালি ডিলাক্স এক ডজন, দাম ৭৫ টাকা। তুবড়ি আছে তিন সাইজের— ছোট ১০ টাকা, মাঝারি ২০ টাকা, বড় ৩০ টাকা পিস। দরদাম করলে কিছু কমসমও হচ্ছে। এই সব তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেন, তাই একটু কমে দিলেও পুষিয়ে যায়— জানান এক বিক্রেতা।
উৎসবের মরসুমে বাজার বসানো ছাড়াও এখানকার কারিগরেরা সারা বছরই বাজি বানিয়ে বাইরে বিক্রি করেন। প্রচুর শ্রমিক এই কাজে যুক্ত। দূর-দূর থেকে খরিদ্দারেরাও আসেন। উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহর থেকে দুই যুবক এসে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার বাজি কিনছিলেন। তাঁরা বললেন, “দোকান দেব। গত বছরও এখান থেকেই বাজি নিয়ে গিয়েছিলাম।"
সবুজ বাজি আছে?
একটা বস্তার নীচ থেকে প্যাকেট বার করে দেন এক দোকানি, ভিতরে অনেকগুলো ছোট-ছোট বোমের মতন। দেশে এখনও সামান্য কয়েকটি সংস্থা সবুজ বাজি তৈরি করে। প্রতিটি বাক্সে কিউআর কোড দেওয়া থাকে, যা মোবাইলে স্ক্যান করলে সংস্থার ওয়েবসাইটে ঢুকে যাওয়া যায়। এই বাক্সে তেমন কিছু দেওয়া নেই, কিন্তু এখানে তর্ক করা বৃথা। বরং মোবাইল বার করতেই চারপাশে দোকান চালানো যুবকদের দৃষ্টি সন্দেহে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। আলগোছে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে মোবাইল পকেটে চালান করতে হয়।
নানা সূত্রের দাবি, কলকাতা শহরতলি, কাঁচড়াপাড়া, ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ ও ঝরিয়া, এমনকি তামিলনাডুর শিবকাশি থেকেও পশ্চিম বর্ধমানে অঢেল শব্দবাজি ঢুকেছে। কুলটির সীতারামপুর, বার্নপুর, আসানসোল বস্তিনবাজার এবং দুর্গাপুরের বেনাচিতির কয়েক জন বড় বাজি বিক্রেতার কাছ থেকে খুচরো বিক্রেতারা শব্দবাজি কিনে তা নানা এলাকায় বিক্রি করেছেন। শিলিগুড়ির মহাবীরস্থান, নিবেদিতা মার্কেট, হংকং মার্কেট-সহ বিভিন্ন বাজারে প্রকাশ্যেই নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি হচ্ছে। সবুজ বাজির নামে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেনও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। ফলে কেউ কেউ বাইরে থেকে একটু বেশি দামের আসল সবুজ বাজি আনলেও সে সব বিক্রি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়তৈরি হয়েছে।
পুলিশ কী করছে?
কল্যাণীতে নিষিদ্ধ বাজি বিক্রির কথা শুনে রানাঘাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখছি।” পুলিশ জানায়, গত শুক্র, রবি ও মঙ্গলবার বাজির বাজারে অভিযান চালিয়ে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৩২ কেজি নিষিদ্ধ শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার অখিলেশকুমার চর্তুবেদীরও দাবি, নিষিদ্ধ বাজির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে।
(সহ প্রতিবেদন: নীলোৎপল রায়চৌধুরী ও শুভঙ্কর পাল)