মৃত অনন্যা। নিজস্ব চিত্র
সুইমিং পুলে তরুণীর মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। সেই সঙ্গে জোরালো হচ্ছে সুইমিং পুল কর্তাদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগরে জেলা প্রশাসনের অফিসার্স ক্লাবের সুইমিং পুলে নেমে মারা যান ডাককর্মী, বছর তিরিশের অনন্যা দাস মণ্ডল। কী করে সকলের সামনে এই ঘটনা ঘটল, তার কোনও সদুত্তর মেলেনি।
অনন্যার স্বামী সব্যসাচী মণ্ডল অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। বুধবার তিনি বলেন, “প্রশাসন যতই এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করুক, আমরা সেটা কোনও ভাবেই মানতে পারছি না। যে ভাবে সকলের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তাতে পরিষ্কার যে এর ভিতরে কোনও রহস্য আছে।”
অনন্যার বাপের বাড়ি কৃষ্ণনগরের সেগুনবাগান এলাকায়। বছর চারেক আগে নবদ্বীপের তমালতলা এলাকায় গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স ইনস্পেক্টর সব্যসাচীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের একটি তিন বছরের মেয়ে আছে। অনন্যা চাকরি করতেন কৃষ্ণনগরের হেড পোস্ট অফিসে। অফিসার্স ক্লাবের পাশেই তাঁর অফিস। আর পাঁচটা দিনের মতো মঙ্গলবারও তিনি কাজ সেরে সুইমিং পুলে এসেছিলেন।
অনন্যার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রাতেই চলে আসেন তাঁর সহকর্মীরা। বুধবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তাঁরাও জেলাশাসক পবন কাদিয়ানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনিই অফিসার্স ক্লাবের সভাপতি। কিন্তু তাঁর কথায় অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। পুলিশ ও প্রশাসনের একটা অংশের দাবি, হৃদরোগে অনন্যার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, সে দিন অফিসের সব কাজ ঠিকঠাক শেষ করে তবেই তিনি পুলে এসেছিলেন। আদৌ অসুস্থ ছিলেন না।
হেড পোস্ট অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার অনির্বাণ সাহা বলেন, “আমি দু’বছর ওখানে সাঁতার কেটেছি। প্রথমে কার্ড দেখিয়ে পোশাক বদল করতে হয়। তার পরে কলের জলে স্নান করে পুলে নামতে হয়। অফিস থেকে বেরিয়ে সব কিছু করে পুলে নামতে অন্তত পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট লাগার কথা। অথচ অনন্যার মৃত্যুর বিষয়টি জানাজানি হয়েছে সন্ধ্যা পৌনে ৭টা নাগাদ। এই অল্প সময়ের মধ্যে কী এমন ঘটল?”
অনন্যার বাবা অচিন্ত্য দাস বলেন, “আমার মেয়ের হার্টের কোনও সমস্যা ছিল না। সাঁতারও জানত। ফলে ডুবে যাওয়ার কথা না। তা ছাড়া ওখানে জলের গভীরতাও এতটা নয় যে ডুবে মারা যাবে।” তাঁদের দাবি, অনন্যার সঙ্গে মোট ১৭ জন মহিলা সাঁতার কাটছিলেন পুলে। প্রশিক্ষকেরাও ছিলেন। তেমন কিছু ঘটে থাকলে তাঁরা অনন্যাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন না কেন, সেই প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা।
এ দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই ক্লাব বা জেলা প্রশাসনের তরফে কেউই অনন্যার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ফলে তাঁরাও বুঝে উঠতে পারেননি, ঠিক কী ঘটেছিল। তাই তাঁরা জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁদের দাবি: জেলাশাসক তাঁদের বলেছেন, পৌনে ৭টা পর্যন্ত সাঁতার কাটার সময়। তার পরে সব শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষকেরা পুল থেকে উঠে আসেন। কিছু সময় পরে তাঁদেরই এক জনের নজরে আসে, জলে উপুড় হয়ে কেউ ভেসে আছেন। প্রশিক্ষকেরা ডাকাডাকি করেন। তিনি তাতে সাড়া না দেওয়ায় প্রশিক্ষকেরা জলে নেমে কাছে গিয়ে দেখেন অনন্যা অসাড় হয়ে আছেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে তোলা হয়। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে ‘মৃত’ ঘোষণা করেন।
পরিবারের লোকজনের প্রশ্ন, এত বড় একটা সুইমিং পুলে কি কোনও রকম নজরদারির ব্যবস্থা নেই? জল থেকে ওঠার আগে কেউ নজরও করল না? বিশেষ করে রাতে যখন সাঁতার শেখানো হয়, সেখানে এই সতর্কতা থাকবে না কেন? কেন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার জন্য নেই নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স?
সব্যসাচী বলেন, “যা-ই ঘটে থাক, তা সকলে জল থেকে উঠে যাওয়ার পরে ঘটেনি। সকলের উপস্থিতিতেই ঘটেছে। তা হলে কেন কেউ কিছু বুঝতে পারল না? এত অল্প সময়ের মধ্যে মৃতদেহ ভেসে উঠলই বা কী করে? এ কি সম্ভব? নাকি এর পিছনে অন্য কোনও গল্প আছে?” তাঁদের দাবি, এই মত্যুর পিছনে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রশাসনিক স্তর থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু ময়নাতদন্ত হওয়ার আগে এবং পুলিশের তদন্ত কার্যত শুরু হওয়ার আগেই কি ভাবে তারা এমন সিদ্ধান্তে এসে গেল, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না।
সব্যসাচী বলেন, “এ সব কারণেই আরও বেশি করে মনে হচ্ছে যে কোথাও যেন কিছু একটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা চাইছি, কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানো হোক।”
অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে এ দিন পুলিশের তদন্তকারী অফিসারেরা সুইংমিং পুলে গিয়ে অনন্যার পোশাক সংগ্রহ করেন। জেলার এক পুলিশকর্তার দাবি, প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই এই মৃত্যু। কিন্তু সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এত অল্প সময়ের মধ্যে মৃতদেহ জলের উপরে ভেসে উঠল কী ভাবে? জলে নামা অন্যেরাও বা কিছু জানতে পারলেন না কেন?
কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলা সুপার জাফর আজমল কিদোয়াই বলন, “অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।” জেলাশাসক তথা ক্লাবের সভাপতি পবন কাদিয়ান বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”