ঐতিহ্যশালী সংস্কৃত কলেজ। নবদ্বীপে। ছবি: প্রণব দেবনাথ।
ইতিহাসের ভুল সংশোধন করতে গিয়ে ইতিহাসকেই বেমালুম মুছে দেওয়া হল নবদ্বীপে।
রাজ্যের প্রথম হেরিটেজ শহর বলে ঘোষিত নবদ্বীপের প্রাচীন মঠ-মন্দির, মসজিদ, পণ্ডিতদের ভিটে, নদীর ঘাট, পুরাতন গ্রন্থাগার বা বিদ্যালয় ভবন-সহ শতাধিক ঐতিহ্যবাহী স্মারক চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন। শহরের যে দিকেই চোখ যায় ঘন নীল ফলকে জ্বলজ্বল করছে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রতীক। প্রতিটি ফলকে বড় বড় হরফে কেবল মাত্র স্মারকের নামটুকু খোদাই করা। সব শেষে লেখা— “পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন দ্বারা ঐতিহ্যশালী সম্পদ রূপে ঘোষিত, ২০২০।”
প্রসঙ্গত, এই নিয়ে ফলকগুলি দ্বিতীয় বার লাগানো হল। প্রায় বছরখানেক আগে প্রথম বার ওই সব ঐতিহ্যবাহী স্মারকে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন পরিচয় ফলক লাগিয়ে ছিল। নীল বোর্ডে সাদা হরফে বাংলা এবং ইংরেজিতে লেখা ছিল সেগুলির অতিসংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কিন্তু মাত্র পাঁচ-ছয় লাইনের সেই সব তথ্য ছিল মারাত্মক ভুল ভরা। যা দেখে আঁতকে উঠেছিলেন নবদ্বীপের মানুষজন।
নবদ্বীপে ধামেশ্বর মহাপ্রভু বিগ্রহ সম্পর্কে হেরিটেজ ফলকে লেখা ছিল মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করে ফিরে আসার পর তাঁর স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীকে নিমকাঠ থেকে তৈরি এই মূর্তি উপহার দিয়েছিলেন! পোড়মাতলার ফলকে পোড়ামা সম্পর্কে একটি কথাও উল্লেখ ছিল না। আগমেশ্বরী মন্দির, বুনো রামনাথের ভিটে, রানির ঘাট সম্পর্কে নানা ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছিল। মণিপুর রাজবাড়ির ফলক ছিল ভুলে ভরা। অনু মহাপ্রভুকে অনুপ্রভু, মণিপুর রাজকন্যাকে মহারাজের বোন কিংবা এমন এক জনকে রাজকুমার বলে নামোল্লেখ করা হয়, যার সঙ্গে মণিপুর রাজবাড়ির আদৌ কোনও সম্পর্কই নেই।
যা দেখে ক্ষুব্ধ শহরের বিভিন্ন মন্দির বা ভবন কর্তৃপক্ষ ওই সব ফলক সরিয়ে ফেলার জন্য নবদ্বীপের লোকাল হেরিটেজ কমিশনের কাছে লিখিত ভাবে দাবি জানান। তাঁদের অভিযোগ ছিল, ওই সব ফলকের ভুল তথ্যে নবদ্বীপের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শুরু হয় সংশোধনের কাজ। সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয় নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব এবং সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্তকে। তাঁরা তিন মাস ধরে মোট ৫৬টি ফলকের আগাগোড়া সংশোধন করেন। এবং হেরিটেজ কমিশনে সংশোধিত নথি জমা দেন।
সকলেই যখন সঠিক ইতিহাস সংবলিত ফলকের অপেক্ষা করছেন, তখন ঘটল আর এক কাণ্ড। নতুন করে যে ফলকগুলি এল, তাতে সংশ্লিষ্ট ভবনের ইতিহাস সম্পূর্ণ বাদ থেকে গেল। রইল কেবল নামটি। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে এ সব করানোর কী দরকার ছিল?
এই প্রসঙ্গে শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “তিন মাস ধরে পরিশ্রম করে হেরিটেজ নবদ্বীপের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সৌধের ইতিহাস সংশোধনের কোনও মূল্যইথাকল না।”
অন্য দিকে, শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “নবদ্বীপের বিভিন্ন ইতিহাস-প্রসিদ্ধ স্থানকে হেরিটেজ হিসাবে চিহ্নিত করে যে ফলক প্রথম বার লাগানো হয়েছিল, তাতে অসংখ্য ভুল ও অনৈতিহাসিক বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এ নিয়ে প্রতিবাদ ওঠায় আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশোধন কাজের। কিন্তু যা হল, তাতে কোন সৌধ, কেন হেরিটেজ— সেটুকু জানারও উপায় থাকল না।”
নবদ্বীপ লোকাল হেরিটেজ কমিটির চেয়ারম্যান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “বিভিন্ন সৌধের ইতিহাস নিয়ে নানা মত আছে। তাই যাতে তা নিয়ে নতুন করে কোনও বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, সেই জন্য এই সিদ্ধান্ত। মানুষকে ইতিহাস জানানোর জন্য অন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”