নাটকের উৎসবে হিন্দুত্ববাদী হামলা

কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী কল্যাণী নাট্যোৎসবের এটি ২৫তম বর্ষ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা 

কল্যাণী শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৫১
Share:

—ফাইল চিত্র।

নাট্যোৎসবে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে প্রতিবাদ হওয়ায় কর্মকর্তাদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলে হুজ্জুত করল হিন্দুত্ববাদীদের একটি সংগঠন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা হলের ভিতরে ঢুকতে পারেনি। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। নাট্যকর্মীরা তো বটেই, নদিয়ার বিশিষ্ট শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীরা এই হামলার নিন্দায় সরব হয়েছেন।
কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী কল্যাণী নাট্যোৎসবের এটি ২৫তম বর্ষ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নাটক শুরু হওয়ার আগে কয়েক জন যুবক এসে দাবি করে, এই উৎসব করা যাবে না। কারণ এখানে ‘দেশবিরোধী’ কথাবার্তা বলা হচ্ছে। তাদের মতে, সংসদ যে আইন পাশ করেছে, তার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ‘দেশদ্রোহ’। উৎসবের আয়োজক, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তকে বাইরে এসে ক্ষমা চাইতে হবে বলেও তারা দাবি করে। এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। কয়েক জন আয়োজকদের দিকে তেড়ে যায় বলেও অভিযোগ। মাইকে নানা কুকথাও বলা হতে থাকে।
হিন্দুত্ববাদী ওই সংগঠনের সমর্থনে কল্যাণী পুরসভার পাশে ঋত্বিক মঞ্চে উৎসবস্থলে এসে হাজির হয়েছিলেন বিজেপির নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা কমিটির সদস্য চঞ্চল পাল। তাঁর দাবি, ‘‘দেশে থেকে যারা দেশের আইনের বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদের ছেড়ে কথা বলা হবে না। যারা জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে, তাদের এ দেশে থাকার দরকার নেই।’’ পরে পুলিশ এসে তাঁদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়। পুলিশের বক্তব্য, কোনও বেআইনি কাজ হয়ে থাকলে সেটা তারা বুঝবে। কোনও স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের তা দেখার কাজ নয়।
নাট্যচর্চা কেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, এই উৎসবে মঞ্চস্থ কোনও নাটকেই নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে কিছু ছিল না। গত ২০ ডিসেম্বর ‘বেলঘরিয়া অভিমুখ’ গোষ্ঠীর একটি নাটকের শেষে কলাকুশলীরা ‘নো সিএএ, নো এআরসি’ লেখা একটি ব্যানার তুলে ধরেন। নাটকের নির্দেশক কৌশিক চট্টোপাধ্যায় মঞ্চে হাজির ছিলেন। কিশোরও মঞ্চে উঠে জানান, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে এই আইন বা পঞ্জি সমর্থন করেন না। এর পরেও একাধিক দলের নাটকের শেষে ওই আইন এবং নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। এতেই হিন্দুত্ববাদী দেশভক্তদের গাত্রদাহ হয়েছে।
নাট্যচর্চা কেন্দ্রের পরিচালন সমিতির সদস্য দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য জানান, প্রতি বছরই নাট্যোৎসবে যে সমস্ত নাটক অভিনয় করা অভিনীত হয়, তার অনেকগুলিতেই সামাজিক বা রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম পর্বে বামেদের বিরুদ্ধে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। আবার বর্তমান রাজ্য সরকারের কাজের সমালোচনা করা নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু কেউ কখনও এই রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেনি।
এ দিন নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নিজের নাটকই মঞ্চস্থ হচ্ছিল। কিশোর মঞ্চে ওঠার আগেই দাবি করা হয়, তাঁকে বাইরে এসে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে পুলিশ তাঁকে হল থেকে বেরোতে দেয়নি। অভিনয় শেষ হওয়ার পরে কিশোর বলেন, ‘‘সরকারের কোনও পদক্ষেপে আপত্তি থাকলে প্রতিবাদ জানানো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তার মানেই আইনভঙ্গ করা নয়, দেশবিরোধী কথা বলা তো নয়ই। সরকার মানেই তো দেশ নয়। যদি আমরা সত্যিই কোনও অপরাধ করে থাকি, আইনরক্ষকেরা দেখবেন। কারও কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’’
‘শান্তিপুর সাংস্কৃতিক’ গোষ্ঠীর নির্দেশক কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা মনে করেছি, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই নাটকের শেষে ওই ফ্লেক্স তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে দেশদ্রোহিতার প্রশ্ন নেই। ক্ষমা চাওয়ারও নেই। কিশোরদা কোনও অন্যায় করেননি।’’ তিনি মনে করিয়ে দেন, সুপ্রাচীন গ্রিক থিয়েটার থেকে আধুনিক থিয়েটার পর্যন্ত হাজার-হাজার বছর ধরে রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপকে প্রশ্ন করে এসেছে। এটাই থিয়েটারের উত্তরাধিকার। তাঁর মতে, ‘‘থিয়েটারের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা কোনও গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে হওয়া কাম্য নয়। প্রতিরোধ জরুরি।’’ ‘চাকদহ হযবরল’ গোষ্ঠীর নির্দেশক চন্দন সেন বলেন, ‘‘হিন্দুত্ববাদীদের হামলা, নাট্যাভিনয়ের উপরে এই জুলুম আমি ও আমার মতো নাট্যকর্মীরা তীব্র প্রতিবাদের যোগ্য বলে মনে করছি। এর প্রতিরোধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’’
সাহিত্যিক আনসারউদ্দিনের মতে, ‘‘রাষ্ট্র যদি জনগণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে তা হলে জনগণও তার প্রতিবাদ করবেই। নাটক হল সেই প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম।’’ কবি জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘নাটক এমন এক মাধ্যম যার মাধ্যমে মানুষ তার মত প্রকাশ করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কেউ তা ছিনিয়ে নিতে পারে না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement