আদালত থেকে সাক্ষ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছেন ছবিদেবী। —নিজস্ব চিত্র।
তাঁর বয়স এখন একাশি। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। মাত্র ক’দিন আগে তাঁর অসুস্থতার কারণে শুনানি পিছিয়ে দিতে হয়েছে। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল যে আদৌ তিনি সাক্ষ্য দিতে পারবেন কিনা। কিন্তু একমাত্র ছেলের খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিতে বৃহস্পতিবার আদালতে এসে কোনও বিরতি ছাড়া টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা দুঁদে আইনজীবীদের চোখে চোখ রেখে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সকলকে চমকে দিলেন ছবিরানি নন্দী। তিন বছর তিন মাস আগে নবদ্বীপে খুন হওয়া সিপিএম নেতা অরুণ নন্দীর বৃদ্ধা মা।
বৃহস্পতিবার ছিল অরুণ নন্দী হত্যা মামলার প্রথম দিনের শুনানি। এ দিনের একমাত্র সাক্ষী ছিলেন অরুণবাবুর অশীতিপর মা। দুপুর দুটোয় ভিড়ে ঠাসা নবদ্বীপের অতিরিক্ত জেলা এবং দায়রা বিচারক সুধীর কুমারের এজলাসে শুনানি শুরু হয়। শারীরিক কারণে আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় একটি চেয়ারের উপর আরও একটি কাঠের টুল দিয়ে পাঁজাকোলা করে বসানো হয় ছবিদেবীকে। তাঁকে সারাক্ষণ ধরে ছিলেন এক মহিলা পুলিশকর্মী। উল্টো দিকে অভিযুক্তের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন নবকুমার দত্ত। পরনে চকোলেট রঙের প্যান্ট এবং হাল্কা রঙের হাফশার্ট। অন্য অভিযুক্ত অরুণবাবুর স্ত্রী উৎপলাদেবীকে অবশ্য কাঠগড়ার ভিতরে দাঁড়াতে হয়নি। কচি কলাপাতা রঙের জমি ও জরির নকশা করা বেগুনি পাড়ের তাঁতের শাড়ি পরেতিনি কাঠগড়ার বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। দীর্ঘ শুনানি চলার কারণে পরে অবশ্য তিনি একটি চেয়ারে বসেন।
এ দিন শুরুতেই ছবিদেবীকে প্রশ্ন করেন এই মামলার বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি দেবাশিস রায়। তাঁকে সহায়তা করেন নবদ্বীপ আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি সনৎকুমার রায়। প্রথমে দেবাশিসবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ছবিদেবী জানান, তাঁদের বাড়ির অবস্থান, বাড়িতে কোন তলায় ক’টি ঘর, কে কোন ঘরে থাকতেন। এরপর দেবাশিসবাবু তাঁকে প্রশ্ন করেন ছবিদেবীর ছেলে বেঁচে আছেন কিনা। চোয়াল শক্ত করে বৃদ্ধা উত্তর দেন, ‘‘না, সে মৃত। দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরে খাটের উপর তাঁকে খুন করা হয়েছিল।’’ সরকারি কৌঁসুলি সেই রাতের ঘটনা মনে আছে কিনা জানতে চাইলে ছবিদেবী বলেন, ‘‘সব মনে আছে। স্পষ্ট মনে আছে।”
এরপর ছবিদেবী জানান, ঘটনার দিন (৩১ মার্চ, ২০১৩) রাতে দোতলায় অরুণবাবুর ঘরে বসে ছবিদেবী ও তাঁর বউমা, উৎপলাদেবী টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন। অরুণবাবু গিয়েছিলেন রাধাবাজারে দলীয় রাজনৈতিক মিটিঙে। এমন সময় নব দত্ত উৎপলাদেবীকে ‘ম্যাডাম ম্যাডাম’ বলে ডাকতে ডাকতে ঘরে আসেন। নব দত্ত পোড়াঘাটের বাসিন্দা এবং প্রায়ই অরুণবাবুর অনুপস্থিতিতে তিনি বাড়িতে আসতেন। ছবিদেবী নববাবুকে পছন্দ করতেন না। সেই কারণে তিনি ঘরে ঢুকতেই ছবিদেবী নিজের ঘরে চলে যান।
দেবাশিসবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ছবিদেবী জানান, বাড়িতে তিনি ছাড়া অরুণবাবু, উৎপলাদেবী, তাঁদের একমাত্র ছেলে এবং ছবিদেবীর এক নাতনি থাকতেন। কিন্তু সে দিন বাড়িতে নাতি বা নাতনি কেউই ছিল না। ঘরের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন, উৎপলাদেবী নববাবুকে ভাত এবং উপরের বারান্দায় রাখা ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে খেতে দিচ্ছেন। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন অরুণবাবু। তিনি মাকে নিয়ে নীচে খেতে নামেন। রাতের খাওয়া সেরে ছবিদেবী নিচের সব দরজায় তালা দিয়ে উপরে উঠে যান। কিন্তু সেই রাতে তাঁর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। রাত বারোটা নাগাদ বারান্দায় অরুণবাবু, উৎপলাদেবী এবং নব দত্তর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন ছবিদেবী।
ছবিদেবী জানান, ওই তিন জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছিল। তিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে ছেলে অরুণবাবুকে ঘটনার কথা জানতে চান। ছবিদেবী আইনজীবীদের বলেন, ‘‘অরুণ বলেছিল, ‘মা তুমি উঠে এলে কেন?’ আর বউমা বলেছিল, ‘সব কথা তোমায় শুনতে হবে?’ এরপর আমার চোখের সামনেই বউমা ছেলেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায় এবং এবং নব দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর আমি নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি।’’
ছবিদেবী এজলাসে দাঁড়িয়ে জানান, এরপর বেশ কিছুক্ষণ তিনি কোনও সাড়া শব্দ পাননি। রাত দুটো নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি দেখেন যে, অরুণবাবুর ঘর, বারান্দা, সিঁড়ি—সর্বত্র আলো জ্বলছে। এরপর তিনি ফের নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে উৎপলাদেবী কাঁদতে কাঁদতে এসে ছবিদেবীকে জানান যে, ডাকাতেরা এসে অরুণবাবুকে খুন করে রেখে গিয়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে অরুণবাবুর ঘরে ছুটে গিয়ে দেখেন অরুণবাবুর রক্তাক্ত দেহ বিছানায় পড়ে আছে। ঘরের মেঝেয় রক্ত। তিনি তাড়াতাড়ি নীচে নামার জন্য ফ্রিজের মাথা থেকে চাবি নিতে গিয়ে দেখেন সেখানে চাবি নেই। সব দরজা খোলা। তিনি বলেন, ‘‘নীচে নামতে গেলে বৌমাও বাধা দিয়ে বলল, ‘কাউকে কিছু বোলো না। এখন তোমার ছেলে নেই। ডাকাতরা তোমাকেও কেটে ফেলবে।’ তবে আমি বৌমার কথা শুনিনি।’’
ছবিদেবী জানান, তিনি নীচে নেমে তাঁর পাশের বাড়ির তপন বাগচীকে চিৎকার করে ডেকে অরুণবাবুর খুন হওয়ার কথা জানান। তারপরে ঘটনার কথা সকলেই জানতে পারেন। আদালতে দাঁড়িয়ে এ দিন ছবিদেবী স্পষ্ট বলেন, ‘‘আমার ছেলেকে ডাকাতেরা খুন করেনি। বৌমা সঙ্গে নবর সম্পর্ক প্রায় চোদ্দো-পনেরো বছরের। ওঁরা দু’জনেই সেই রাতে খুন করেছিল অরুণকে। কোনও ডাকাত আসেনি।’’ এরপরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ৮১ বছরের ছবিরানিদেবী। তাঁকে এক এক করে দেখানো হয় সেই রাতে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা বালিশ, রক্তমাখা চাদর, অরুণবাবুর পরনের লুঙ্গি, আংটি ও উৎপলাদেবীর গয়না। তিনি সব কিছুই শনাক্ত করেন। শনাক্ত করেন তাঁর বউমা এবং নব দত্তকেও। এরপর তাঁকে জেরা শুরু করেন উৎপলাদেবীর দুই আইনজীবী দিলীপ চট্টোপাধ্যায় এবং সুবীর দেবনাথ। তাঁদের দীর্ঘ জেরায় ছবিদেবী কখনও রেগে ওঠেন আবার কখনও কেঁদে ফেলেন। সব শেষে তাঁকে জেরা করেন নব দত্তের আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায়। খুব অল্প সময়ের জন্য অশোকবাবুর জেরার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় এ দিনের সাক্ষ্য। আদালতে এ দিন হাজির ছিলেন নব দত্তের স্ত্রী, অরুণবাবুর বোন, অরুণবাবুর দলের সহকর্মীরা। ছিলেন নবদ্বীপ থানার আইসি।