বিকেল পড়ে এসেছে। বিষণ্ণ জলঙ্গির বুকে তিরতির কাঁপছে কুসুমরঙা সুয্যি।
—ও কত্তা, বিড়ি হবে নাকি একখান?
মিহি গলা শুনে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন বিমল হালদার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, চুপিসাড়ে তাঁর ঠিক পিছনে এসে বিড়ি খাওয়ার আবদার করছেন তাঁরই পাড়ার বুদ্ধ। দুপুর থেকে নদীতে মাছের খোঁজ করছিলেন বিমল। ক’দিন ধরেই নদীতে মাছ মিলছে না বড় একটা। কোথা থেকে যেন কালো জল এসে মিশেছে নদীতে। তার পর থেকেই যেন মাছগুলো গা ঢাকা দিয়েছে। কয়েকটা কুচো চিংড়ি আর খানকয়েক পুঁটি ছাড়া কিছুই মেলেনি।
বুদ্ধকে তিনি ডেকে নেন নৌকায়। বাপি হালদার ছিপ নিয়ে বসেছিলেন। ছিপ গুটিয়ে তিনিও এসে জুটলেন ছইয়ের নীচে। বিড়ি ধরিয়ে জমে উঠল সান্ধ্য-আড্ডা। এ কথা, সে কথার পরে বাপি শুধোন, ‘তা কত্তা রাতবিরেতে মাছ ধরো। কখনও তেনাদের দেখোনি?’ বিমল বলেন, ‘মাছ ধরতে গিয়ে আমি দেখিনি বটে। তবে দেখেছে অনেকেই। আমি সেই ছেলেবেলায় এক বার অবশ্য দেখেছিলাম। ডাংগুলি খেলার সময়। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। গুলিটা বাঁশ বনে ঢুকে গিয়েছিল। এ দিক ও দিক খুঁজছি। আচমকা দেখি, সাদা থান পরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে। কিছুটা এগোতেই দেখি, সে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। ভরসন্ধ্যায় বাঁশবনে কে চুল আঁচড়াচ্ছে? ভয়ও লাগছে। আবার কৌতূহলও হচ্ছে। কিছুটা এগোতে দেখি, সে-ও এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে সাত-পাঁচ ভাবছি। এমন সময় খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ। কী বলব ভায়া, সে শব্দ হাসি শুনে শিউরে উঠেছিলাম। তার পরে দে ছুট। পরে আর কোনও দিন বিকেলের পরে ওই রাস্তা মাড়াইনি।’ বাপি বলেন, ‘যাই বলো খুড়ো, তোমার সাহস ছিল জব্বর। আমরা হলে তো ভিরমি খেতাম গো!’
আর একটা বিড়ি ধরিয়ে ফের শুরু করেন বিমল, ‘সে যদি বলিস, ভয় পেয়ে অনেককে বাড়িতে বসে যেতে দেখেছি। বছর কয়েক আগের কথা। রাত বারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে ইলিশ মাছ আর ভাত খেয়ে আমরা মাছ ধরতে বেরোলাম। ওই যে দূরের জোড়া পিটুলি গাছ দেখছিস, ঠিক ওইখানে মাছ ধরতে বসেছিল আমাদের গোপাল হালদার। হঠাৎ দেখে, কে একজন নদীর পাড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে। গোপাল ভাবল, নিশ্চয় কোনও বদ লোক মাছ চুরি করতে এসেছে। অন্য দিকে তখন ডিঙি নৌকায় মাছ ধরছিল দুলাল। গোপাল হাঁক দেয়, ‘ও দুলাল দা, একবার এ দিক পানে এসো তো।’ ডিঙি এসে থামে গোপালের কাছে। গোপাল তাকে বলে, ‘একটু দেখো তো দুলালদা, ওই লোকটা কী চায়? দেখে তো সুবিধার ঠেকছে না। দুলাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘লোক কোথায়! কেউ তো নেই সেখানে।’ গোপাল কিন্তু তখনও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আবছা মূর্তিটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।’
গল্পটা শুনতে শুনতে বুদ্ধ বলে, ‘ওটাই তো মজা। সবাই তো তেনাদের দেখতে পায় না। যাকে দেখা দেয়, সেই শুধু দেখতে পায়।’ বিমল বলে, ‘আরে শোনোই না পুরোটা। দুলাল তো নাগাড়ে বলে যাচ্ছে, ‘কোথায় রে, কই, কেউ তো ওখানে নেই।’ এ দিকে গোপাল তখনও কেঁপে চলেছে। মুখে কোনও কথা সরছে না। দুলাল বুঝতে পারে, গোলমাল কিছু একটা হচ্ছে। তারই মধ্যে গোপাল ‘বু-বু-বু-উ-উ’ করতে করতে টলছে। সঙ্গে সঙ্গে পাড়ে নিয়ে গিয়ে হাত পা ঘষে তার জ্ঞান ফেরানো হয়।’ পরে গোপাল জানায়, ‘দুলালদা কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। এ দিকে সেই মূর্তি আমার দিকে তাকিয়ে নাগাড়ে হেসে চলেছে। সেই হাড় হিম করা দৃশ্য আমি কোনও দিন ভুলব না।’
গল্প শেষ হতেই বিমল বলেন ‘এই দেখো, কথায় কথায় রাত হয়ে এল। এ বার পেটে দানাপানির ব্যবস্থা করতে হবে তো?’ ‘যা দু’-দশ টাকা হয়’, বলে মাছগুলো নৌকার খোলের মধ্যে থেকে গামলায় তুলতে থাকেন বিমল। মাথা তুলে বুদ্ধদের তিনি বলেন, ‘সেই ঘটনার পরে গোপাল তো মাছ ধরাই ছেড়ে দিল। সন্ধ্যার পরে সে আর একা কোথাও বেরোয় না।’
রাতের বয়স বাড়তে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নৌকার ছইয়ের নীচে ফস করে জ্বলে ওঠে দেশলাই।
(চলবে)