অপরিচ্ছন্ন: স্বরূপগঞ্জে গঙ্গার হাল। নিজস্ব চিত্র
সেই কবে, ১৮৭২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র ‘লোকরহস্যে’ লিখেছিলেন — “...যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু”।
নদীমাতৃক বাংলার মানুষ নদীকে যে আসলে কী চোখে দেখে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সে দিনই। প্রায় দেড় শতক পরে দশহারায় গঙ্গাপুজোর ধুম সেই কথাটাই মনে করায়। বছরে বাকি একটি দিনও নদীর কথা কারও মনে থাকে না। চলতে থাকে নির্যাতন।
স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান: জ্যৈষ্ঠের শুক্লা দশমীতে গঙ্গাস্নানে দশবিধ পাপমুক্তি ঘটে। কেননা, পুরাণমতে ওই দিনই ভগীরথ মহাদেবের জটবন্দি গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন। তাই এত ধুম! সেই হট্টগোলে কেউ নদীর খোঁজ রাখে না।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে গঙ্গার প্রবাহপথে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। মাঝের সময়টুকুতে একটু-একটু করে জল ভাগীরথী থেকে চলে গিয়েছিল পদ্মার খাতে। তখনই নদীর হারানোর শুরু। ২২০.৫ কিলোমিটার জলঙ্গির কোথাও এখন আবাদি জমি, কোথাও রাজ্য সড়ক। চরমধুবোনা থেকে মোক্তারপুর পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার হারিয়ে গিয়েছে। ১৯৫৯-তে জলঙ্গি–করিমপুর সড়ক গড়ার সময়ে সরকারি উদ্যোগে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা।
এক ভাবে, মুর্শিদাবাদের কান্দিতে কানা ময়ূরাক্ষীর ‘কাঁদরের’ উপরে সেতুর বদলে কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। ডোমকলে গুমানি নদীর বুকে মাটি ফেলে রাস্তা করেছে তেকারায়পুর-বালুমাটি পঞ্চায়েত। মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের যোগাযোগের জন্য কানা ময়ূরাক্ষীর উপরে কান্দি-কুলি ব্রিজ সংস্কারের সময়ে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে নদীর বুক। মৎস্য সমবায়গুলি যে লিজের নামে নদীকে পৈতৃক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে, তা-ও সকলের জানা।
নতুন কী?
সপ্তদশ শতকে কৃষ্ণনগরের কাছ থেকে বেরিয়ে দোগাছিতে দু’টি ধারায় বিভক্ত হত জলঙ্গির শাখা অঞ্জনা। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত (১৮৫৭) বইতে অঞ্জনার কথা মেলে। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, ১৬৮৪ সালে রাজা রুদ্র রায় নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়ার পরে সেটি মজে যায়।
নদী গবেষক সূর্যেন্দূ দে-র মতে, গত দুই শতাব্দীতে হারিয়েছে অনেক নদী। যেমন কুলকুলি, খড়খড়ি, শিয়ালমারি, দ্বারকা, গুমনি, কালমন। ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী গোবরানালা আজ নেই। ইছামতী, ভৈরব, চূর্ণী এখন মরসুমি নদী। বর্ষার কয়েক মাস তাদের আয়ু।
শুধু ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ কিংবা ‘নমামী গঙ্গে’ দিয়ে এই নদীলোপ রোখা যাবে কি?