ঘিঞ্জি বাজারে বেরোবার জায়গা কই। রঘুনাথগঞ্জে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
ঘড়ির কাঁটায় সবে সকাল ৭টা ছুঁয়েছে। শীতকাল। তখনও ভাল করে ঘুম ভাঙেনি রঘুনাথগঞ্জের। খবর এল ঝড়ের বেগে। শহরের বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া জনবহুল বাজারের দোতলায় একটি কম্পিউটারের দোকানের বন্ধ শাটারের ফাঁক গলে গলগল করে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। চমকে উঠেছিলেন স্থানীয় লোকজন। ছুটে আসেন দোকান-মালিক রিন্টু শেখ।
ধুলিয়ান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে ঘন্টা খানেক পরে যতক্ষণে দমকল এসে পৌঁছয়, আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ওই এলাকায় শতাধিক দোকান, একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক, পেট্রল পাম্প। স্বাভাবিক ভাবেই এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনার মাস কয়েক পরের কথা। ভোর ৫টা নাগাদ রঘুনাথগঞ্জেই একটি অর্থলগ্নি সংস্থার অফিসের ৪ তলা ভবনে আগুন লাগে। তালা বন্ধ ভবনের বেসমেন্টে লাগা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় যাবতীয় নথিপত্র। ওই ভবনের উল্টো দিকে থাকা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের নৈশপ্রহরী প্রথম ধোঁয়া বেরতে দেখে থানায় ফোনে খবর দেন। থানা থেকে খবর যায় ধুলিয়ানের দমকল কেন্দ্রে। প্রায় ৫ ঘন্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।
কয়েক মাসের ব্যবধানে দু’টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে শহরের বুকে। রঘুনাথগঞ্জ শহরে জনবহুল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রায় শতাধিক দোকানঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে একাধিক মার্কেট কমপ্লেক্স। পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ওই সব দোকানে চলছে কোটি টাকার ব্যবসা। অথচ কোথাও আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই। দমকলের ছাড়পত্র না নিয়ে পুরসভা কী ভাবে ওই সব দোকানকে ট্রেড লাইসেন্স দিল, তা ভেবে পাচ্ছেন না দমকলের কর্তারাও।
শুধু তা-ই নয়, একাধিক ব্যাঙ্ক থেকে আর্থিক ঋণ নিয়ে খোলা হয়েছে বহু দোকান। বিভিন্ন বিমা কোম্পানি সেই সব দোকানের বিমা করেছে। কোনও ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্ক বা বিমা সংস্থাগুলি দমকলের ছাড়পত্র খতিয়ে দেখেনি।
পুরসভার নিজস্ব বাজারের অবস্থা কী? ১০০টিরও বেশি দোকান সেখানে। সামনেই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে অন্তত ৩০টি বাস। অথচ কোথাও সামান্যতম অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাও নেই, যাতে প্রাথমিক ভাবে অগ্নিকান্ড রুখতে তা সহায়তা করবে।
পাশেই মিঞাপুর চালের বাজার। দৈনিক কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা করে অন্তত ১০০টি দোকান। সেখানেরও এক ব্যবস্থা নেই।
পূর্ত দফতরের এক কর্তার গলায় শোনা গেল ক্ষোভের সুর। তাঁর অভিযোগ, “ভাগীরথী সেতুর নীচে জবর দখল করে গজিয়ে উঠেছে কয়েকশো দোকান। সেতুর তলায় একবার কয়েকটি দোকানে আগুন লেগে যায়। তাতে সেতুর গার্ডার নষ্ট হয়ে গিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে পূর্তদফতরকে। বেআইনি সেই সব দোকানকে ট্রেড লাইসেন্স কে দিল, বিদ্যুৎ সংযোগই বা কে দিল, ভেবে পাচ্ছি না আমরা।”
রঘুনাথগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি বিকাশ নন্দ বলছেন, “এ ব্যাপারে শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সরকারি পর্যায়ে নজরদারি না থাকার ফলেই এ সব অনিয়ম সম্ভব হয়েছে। সব চেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা বিদ্যুৎ সংযোগের। আগুন লাগার সব চেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে শর্ট সার্কিট থেকেই। কোনও বাজারে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই। তাই পুরসভা কিংবা দমকল, দায়িত্ব এড়াতে পারে না কেউই।”
জঙ্গিপুর মহকুমায় একমাত্র দমকল কেন্দ্র রয়েছে ধুলিয়ানে। ওই কেন্দ্রের আধিকারিক বিষ্ণুপদ রায় বলছেন, “রঘুনাথগঞ্জ শহরের কোনও বাজারেই দমকলের ছাড়পত্র নেই। একাধিক নার্সিং হোম, এমনকী সরকারি হাসপাতালেও ছাড়পত্র নেওয়া হয় না। আমরা বহুবার নোটিশ পাঠিয়েছি। সকলকে তার অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা দেখিয়ে দমকল থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তা নেওয়া হয় না। পুরসভাও এ ব্যাপারে ততটা ততপর নয়। দমকলের অনুমতি ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করা উচিত পুরসভার। তা হলে কিছুটা হলেও আশঙ্কা কমবে।”
এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেননি জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম। বললেন, “ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরসভা সব সময় সরকারি নিয়ম মেনে চলতে পারে না। নানা চাপ থাকে। ফলে শহরের কোনও দোকানেরই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা সে ভাবে পরীক্ষা করা হয় না। খুব শীঘ্র এ নিয়ে কথা বলব দমকলের সঙ্গে। শুধু আমরা অপেক্ষায় আছি কবে পৃথক একটি দমকল কেন্দ্র তৈরি হবে জঙ্গিপুরে।”