ভোটার কার্ড হাতে ইহান্নবি (বাঁ দিকে)। নয়া ভোটার কার্ড। নিজস্ব চিত্র
ইহান্নবিকে কেউ চেনেন না। গ্রামে পা দিয়ে পরিচয় দিলে লোকে মাথা চুলকোয়, চেহারার বর্ণনা দিয়ে আলগোছে রাজনৈতিক পরিচয়টুকু ভাসিয়ে দিলে এক গাল হেসে পড়শিরা বলেন— ‘ও, আমাগো সিপিএম শেখের কথা বলত্যাসেন, ও আবার ইহান্নবি অইল কবে!’
তবু, শেষ পর্যন্ত সিপিএমের মায়া ছেড়েই দিলেন ইহান্নবি। পুরনো বোলচাল, আগের মতোই রয়ে গিয়েছে তাঁর, হাসিটাও আবিকল রয়ে গিয়েছে পুরনো। পুরোন সেই দল, হারানো নামের মতো ফিকে হয়ে এসেছে বটে, তবে ইহান্নবির নামখানা এখনও রয়ে গিয়েছিল সিপিএম, সিপিএম শেখ।
কিছু দিন যাবৎ এনআরসি’র জুজু তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। ভোটার থেকে রেশন সব কার্ডেই সিপিএম শেখ হিসেবে পরিচিত ইহান্নবি তাঁর পুরনো নামে ছুঁয়েছিলেন শুধু আধার কার্ডে। আর তাতেই তাঁর পরিচয় নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়ে গিয়েছিল। নয়া নাগরিকত্ব আইনের সেই ভয়ে বাপ-মায়ের রাখা সেই আদিম নামে ফিরতে চাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল তাঁর। শেষতক, ভোটার কার্ডে নাম সংশোধনের পরে সেই পুরনো উঠোনেই ফিরে এলেন ইহান্নবি।
নওদার ঝাউবোনা এলাকায় বাসিন্দা ইহান্নবি। কিন্তু এলাকার কেউ এমনকি তার পরিবারের লোকেদের অনেকেই ভুলে গিয়েছেন আসল নামখানা। পাড়ার ছোট থেকে বৃদ্ধ, আঙুল উচিঁয়ে দেখিয়ে দেন ‘সিপিএম শেখের’ ঘরবসত। ইহান্নবি বলছেন, ‘‘এনআরসি’র ভয়ে সাধের নামটাই ছেড়ে দিতে হল, বড় কষ্ট হচ্ছে গো!’’
ভরা বাম আমলে জন্ম। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৭৮ সালে জন্ম হয় ইহান্নবির। সে বছরই পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে তাঁর কাকা আনার আলি, কেদারচাঁদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হন। পরিবারের লোকজন সেই থেকে তাকে ‘সিপিএম’ নামেই ডাকতে শুরু করেন। ক্রমে ভোটার তালিকা, ভোটারকার্ড, রেশনকার্ডেও ইহান্নবি হয়ে ওঠেন সিপিএম শেখ। এখানেই শেষ নয়, ছেলে-মেয়ের জন্ম শংসাপত্র, রেশনকার্ড সবেই পিতার নামের জায়গায় জ্বলজ্বল করছে সিপিএম সেখ। শুধু আধার কার্ডে নাম ইহান্নবি। এই দ্বৈত চরিত্রই শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছিল তাঁর! এআরসি’র ভয়ে পাছে দেশ ছাড়তে হয়— মাস কয়েক ধরে পাগলের মতো তাই নাম বদলের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ইহান্নবি। হন্যে হয়ে তিনি ছুটেছেন কখনও পঞ্চায়েত কখনও বা বিডিও’র দফতরে। কোর্টে এফিডেভিট করার পর নাম পরিবর্তন করতে তাঁকে দিতে হয় খবরের কাগজেও বিজ্ঞাপনও। মাস দুয়েক আগে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ চলছিল। মরিয়া সিপিএম শেখ সেখানেও ফর্ম ৬ পূরণ করে জমা দেন। ফল বেরলো দেখা যায় ‘পাশ’ করেছেন তিনি। চল্লিশ বছরের মায়া ছেড়ে পুরনো হাসি নিয়েই তাই ছাপোষা ইহান্নবিতে ফিরে গেলেন তিনি!