Dolphins Dying

মাছ ধরতে জলে বিদ্যুৎ, নাগাড়ে মরছে ডলফিন

মাঝে মধ্যেই নেমে আসে শোকের ছায়া। কারণ, মাঝে মধ্যেই ভাগীরথীর জলে ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে উঠতে দেখা যায়।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:২৭
Share:

মৃত ডলফিন। নয়াচরে। ছবিটি গণেশ চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত 

সূর্যের তেজ একটু কমতেই খাড়ির জলে ঘাই মেরে আকাশের দিকে লাফিয়ে ওঠে ছোট্ট গাঙ্গেয় ডলফিনের বাচ্চাটা। তার পিছন পিছন আরও কয়েকটা। সকলেই নরম সূর্যের আলো গায়ে মেখে জলের উপর খেলা করে। পিছনে তাদের মা ডলফিন বা শুশুকেরা নিজেদের মতো করে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে মাছ ধরে বাচ্চাদের খেতে দেয়। বাচ্চারা খেলতে খেলতেই মায়েদের কাছ থেকে মাছ খাওয়া, মাছ ধরা শিখতে থাকে। আর পাড়ে দাঁড়িয়ে এক, দুই, তিন করে তাদের সংখ্যা গুনতে থাকে নয়াচরের মানুষ। শিশুরা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।

Advertisement

কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মাঝে মধ্যেই নেমে আসে শোকের ছায়া। কারণ, মাঝে মধ্যেই ভাগীরথীর জলে ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে উঠতে দেখা যায়। প্রতি বছরই মৃত ডলফিনের দেখা মিলছে। গত বছরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, জুলাই, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে তিনটি শিশু ও একটি পূর্ণবয়স্ক ডলফিনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এক সঙ্গে দু’টি ডলফিনের বাচ্চার দেহ উদ্ধার হয়। যাদের বয়স নয় থেকে ১০ মাসের মধ্যে। স্থানীয়দের দাবি, বেশ কিছু মৎস্যজীবী বিদ্যুৎবাহী লম্বা লম্বা লোহার রড ব্যবহার করে মাছ শিকার করে। একাধিক বড় বড় ব্যাটারি ও স্টেবিলাইজ়ারও ব্যবহার হয়। জলের ভিতরে বিদ্যুতের শক খেয়ে বড় বড় মাছ লাফিয়ে উঠলে বা ফেঁসে গেলে জাল দিয়ে সেই সমস্ত মাছ ধরা হয় বলে স্থানীয়েরা জানান।

আর এ ভাবে মাছ ধরতে গিয়েই একের পর ডলফিনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। দীর্ঘ দিন ধরে গাঙ্গেয় ডলফিন নিয়ে কাজ করে আসা ভাগীরথীর পাড়ের নয়াচরের বাসিন্দা গণেশ চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘বিদ্যুতের শক দিয়ে মাছ ধরতে গিয়েই ডলফিন হত্যা করা হচ্ছে। আমরা এ বছর তিনটি বাচ্চা ও একটি পূর্ণবয়ষ্ক ডলফিনের দেহ উদ্ধার করেছি। তার মধ্যে তিনটি দেহ পূর্ব বর্ধমানের বন দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।” তিনি বলেন, ‘‘ডলফিন অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রাণী। সামান্য আঘাতেই মারা যায়। এ ক্ষেত্রে ইলেট্রিক শক খেলে তো মারা যাবেই। আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এখনই এ ভাবে মাছ ধরা বন্ধ করতে না পারলে এখানে ডলফিনের অস্তিত্বই থাকবে না।”

Advertisement

কালীগঞ্জের চর বালিডাঙা দ্বীপের যেখানে অজয় নদ ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে, সেখানে একাধিক খাড়ি তৈরি হয়েছে। বিকেল হতেই সেই খারির শান্ত জলে কার্যত হুল্লোড় শুরু করে দেয় বেশ কয়েকটি গাঙ্গেয় ডলফিন ও তাদের কচিকাচা। জেলা জীববৈচিত্র্য পর্ষদ এখানে কাজ করছে। এই মুহূর্তে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০টির মত পূর্ণবয়ষ্ক ডলফিন বা গাঙ্গেয় শুশুক আছে বলে খবর। ২০২৪ সালে প্রায় ১৩টির মত ডলফিনের জন্ম হয়। তার মধ্যে তিনটির মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় পরিবেশ প্রেমীদের। তাঁদের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে সংখ্যাটা দ্রুত কমতে থাকবে।

কালীগঞ্জের চর বালিয়াডাঙা দ্বীপ-নয়াচর এলাকা প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা ডলফিনদের বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্রটিকে রক্ষা করতে সরকারি ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমীক্ষা চালিয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার ইন্ডিয়া’-র মত সংস্থাও। কাজ করছে জেলা জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা সমিতি। সম্প্রতি কৃষ্ণনগরের ‘কোম্পানী বাগান’-এর পাশাপাশি চর বালিয়াডাঙা দ্বীপকে ‘ঐতিহ্যমন্ডিত জীব বৈচিত্র পার্ক’ বা ‘বায়োডাইভারসিটি হেরিটেজ পার্ক’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই এলাকায় ভাগীরথীর দুই পাড়ে নদিয়া ও পূর্ব বর্ধমান জেলার গ্রামগুলিতে তৈরি হয়েছে ‘প্রকৃতি বন্ধু’-এর মত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। কিন্তু তার পরেও ডলফিনদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। যা নিয়ে চিন্তিত জেলার কর্তারা।

ডলফিন মৃত্যুর খবর সামনে আসার পরেই নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন। আজ মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনিক ভবনে অতিরিক্ত জেলাশাসকের (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) চেম্বারে পুলিশ, মৎসদফতর, কৃষ্ণনগর মহকুমাশাসক, কালীগঞ্জের বিডিওদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে ডলফিন-সহ অন্য প্রাণীদের রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে বলে জানা গিয়েছে। অতিরিক্ত জেলাশাসক প্রলয় রায়চৌধুরী বলেন, “ডলফিনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। এমন যাতে আর না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট সমস্ত দফতকে নিয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement