দোলের নবদ্বীপের মঠে-মন্দিরে রঙের প্রবেশ নিষেধ।
বৈষ্ণবনগরী নবদ্বীপের প্রচলিত অনেক প্রথার সঙ্গেই মেলে না মণিপুরের। আয়োজন থেকে উদ্যাপন সবেতেই তারা ভিন্ন। এবং এই স্বাতন্ত্র্য নবদ্বীপ মাঝে এক টুকরো মণিপুরকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নবদ্বীপের দোল এমনিতেই ব্যতিক্রমী। দোল এখানে চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি হিসাবে উদ্যাপিত পালিত হয়। দোলের নবদ্বীপের মঠে-মন্দিরে রঙের প্রবেশ নিষেধ। সন্ধ্যায় মহাপ্রভুর অভিষেকের পর শুধুই আবিরের ছোঁয়া তাঁর রাতুল চরণে।
ব্যতিক্রম শুধু অনু মহাপ্রভুর মন্দির। একমাত্র সেখানেই রং পিচকারি সহযোগে রং খেলা হয় দোল উৎসবের অঙ্গ হিসাবে। ক্যালেন্ডারের হিসাবে দোল যে দিন শেষ হয়, সে দিনেও নবদ্বীপ শহরের দখিন দুয়ার খোলা থাকে। বসন্ত সেখানে প্রবল ভাবে জাগ্রত।
এই দরজা নবদ্বীপের মণিপুর রাজবাড়ির সিংহ দরজা। সাধারণ দোলের পর দিন সেখানে অনু মহাপ্রভুর দোল অনুষ্ঠিত হয়। প্রচলিত দোলের থেকে সব কিছুই এক দিন পরে উদ্যাপিত হয় মণিপুর রাজবাড়িতে। সেটাই মণিপুরের নিজস্ব রীতি। মণিপুর রাজবাড়ির দোলে রঙের সঙ্গে মিলে যায় সুর, আবিরের সঙ্গে নাচের মুদ্রা। পিচকারিতে রং ভরে আবির উড়িয়ে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয়। অবিরল রঙের ধারায় ভিজতে থাকেন আট থেকে আশির মণিপুরের বাসিন্দারা। যাঁদের বেশির ভাগই অনু মহাপ্রভুর মন্দিরে দোল খেলার জন্য সুদূর মণিপুর থেকে ছুটে আসেন নবদ্বীপে।
শুরুটা হয়েছিল সেই ১৭৯৮ সালে। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র রাজকুমারি বিম্বাবতীকে নিয়ে মণিপুর থেকে নবদ্বীপে এসেছিলেন। নবদ্বীপ এবং মণিপুরের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক আশ্চর্য সেতুবন্ধ। সেই পথেই অবিরাম চলাচল কয়েক শতাব্দী ধরে। অতিমারির কালে ভাঁটা পড়েছিল। এ বার মণিপুরের দোলে উপচে পড়ছে ভিড়। শ্রীশ্রী অনু মহাপ্রভু সেবা সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ বলেন, “মণিপুর থেকে এবারে এখনও পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন দোল উপলক্ষে। উৎসবের দিনও বেড়েছে। ২ মার্চ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত এবারের উৎসব চলবে।”
শতাব্দীপ্রাচীন নাটমন্দিরে জমে উঠেছে নৃত্যগীতের আসর। বসন্ত রাগে গাওয়া পদাবলী কীর্তন, থাংতা নৃত্য, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, চাক্ চানাবা এবং বসন্ত রাস— ফাল্গুনি একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে বিশুদ্ধ মণিপুরি ঘরানায় এখানে পালিত হয় রাজবাড়ির বসন্তোৎসব।
শ্রীপঞ্চমীর দিন থেকেই মণিপুর রাজবাড়িতে বসন্ত উৎসব শুরু হয়ে যায়। ‘হরিভক্তি বিলাস’ গ্রন্থ অনুসরণে কঠোর নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে পালিত হয় বিশেষ উৎসব। দোল পূর্ণিমা তিথিতে মহাপ্রভুর আবির্ভাব। তাঁর স্মরণে এখানে পোড়ানো হয় ‘প্রভুর’ আঁতুড়ঘর। মণিপুরের সেটাই ন্যাড়াপোড়া। দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় তার পরই শুরু হয় থাবল চৌংবা। জ্যোৎস্না রাতে সমবেত নৃত্য। একে মণিপুরের জাতীয় উৎসব বলা চলে। মণিপুরের নিজস্ব লোকগানের সুরে নারী-পুরুষ গোল হয়ে এই নাচে অংশ নেন।
সুদূর মণিপুর থেকে বহু দূরে চৈতন্যধামেএখন উৎসবের মাতন। রাজবাড়ির মূল ফটকের সামনের চত্বরে প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন বকুলগাছের নীচে থাবল চৌংবার আসরের প্রস্তুতি চলছে। নিজস্ব ঘরানার উচ্ছ্বাসে ভাসছে মণিপুর।