আপনার অভিমত

তুই সিনেমা চালিয়ে যা ভাই, আমরা তো দেখছি

নন্দন-রবীন্দ্রসদনে বিরাট লাইন। পাসের জন্য আকুল প্রার্থনা। ডেলিগেট কার্ডে নাম ওঠা নিয়ে টেনশন। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসব কি ছড়িয়ে পড়তে পারে না তার বাইরেও? লিখছেন প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য শুরু করেছিলাম সন্ধে ৭টা থেকে। রাত ১১টায় লোকজন কমে এসেছে। আমার হাতে তখনও গোটা চারেক ছবি রয়েছে। আমার এক দাদা এসে বললেন, ‘এ বার বন্ধ করে দে, লোকজন তো একেবারেই নেই।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:১৯
Share:

সেই ১৯৯৭ সালে বহরমপুর থেকে কলকাতায় চলে যাওয়ার সময়ে চলচ্চিত্র উৎসব সম্পর্কে আমার সম্যক কোনও ধারণা ছিল না।

Advertisement

খুব সম্ভবত ১৯৯৯ বা ২০০০ সালে (তখন মনোহরপুকুর রোডে মেসে থাকতাম) কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের দুটো পাস জোগাড় করে আমি আর আমার পিসেমশাই উত্তম মঞ্চে একটি সুইডিশ ছবি দেখি। নাম ছিল ‘ওয়েটিং ফর দ্য টেনর’।

তখনও ছবি করার কাজে যুক্ত হইনি। সেই সময়েই জানতে পারি যে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ছবি নিয়ে দশ দিন ধরে চলচ্চিত্র উৎসব হয়। ছবিটা খুবই ভাল লেগেছিল। আর ভাল লেগেছিল সিনেমা নিয়ে লোকজনের উন্মাদনা। অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে হলে ঢুকেছিলাম।

Advertisement

২০০২-এ রূপকলা কেন্দ্রে ঢুকে আমার চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে সম্যক ধারণা হল। নন্দন, রবীন্দ্রসদনে বিরাট লাইন। একটা পাসের জন্য আকুল প্রার্থনা। ডেলিগেট কার্ডে নাম উঠবে কি না তাই নিয়ে টেনশন ইত্যাদি। সারা বছর ধরে সিনেমা হলগুলোতে যে সব সিনেমা চলে তার থেকে এই সিনেমাগুলো একেবারেই আলাদা।

আজকালকার দিনে বেশির ভাগ ছবিই ইন্টারনেটে কোথাও না কোথাও পাওয়া যায়। যদিও যে কোনও সিনেমা বড় পর্দায় দেখলে তবেই বোধ করি সিনেমার সার্থকতা। সে নির্মাতার ক্ষেত্রেই হোক বা দর্শকের ক্ষেত্রে। সেই সময়ে সিনেমা এবং মোবাইল কোনওটাই সুলভ ছিল না। মোবাইলে শুধু ফোন আর এসএমএস করা যেত। আজকাল মোবাইলে ছবি দেখা যায়, গান শোনা যায়। দর্শকদের এক সঙ্গে ছবি দেখার অভ্যেস কমছে। যখন-তখন ছবি ফাস্ট ফরোয়ার্ড-রিওয়াইন্ড করে নেওয়া যাচ্ছে। ছবিতে লং শটের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছেন পরিচালকেরাও, লং টেকের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছেন। তবুও সারা পৃথিবীর ছবি বড় পর্দায় টানা দশ দিন এক সঙ্গে সবাই মিলে বসে দেখার মজাই আলাদা।

কথা হল, চলচ্চিত্র উৎসব কি শুধু নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরেই সীমাবদ্ধ? নাকি তার তেমনটাই থাকা উচিত?

আমাদের নদিয়ার তেহট্টে প্রতি বছর আমার কাকার উদ্যোগে নাটক এবং গানের উৎসব করা হয়। ২০১০ সালে আমার কাকারা বললেন, নাটক এবং গানের সঙ্গে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র উৎসবও করতে চান। ওঁরা সব ব্যবস্থাপনা করবেন, আমার কাজ শুধু ঠিকঠাক ছবি নিয়ে যাওয়া এবং প্রোজেক্টর ইত্যাদি ঠিকঠাক দেখে নেওয়া। তার পর থেকে প্রতি বছর তেহট্টে স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র উৎসব হয়। কোনও টিকিট লাগে না।

তারই মধ্যে ২০১১-১২ সাল নাগাদ চলচ্চিত্র উৎসব হল একটি প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠে। অপূর্ব অভিজ্ঞতা। বড় পর্দা খাটানো হল। ঠিকঠাক সাউন্ডের ব্যবস্থা হল। অনেক ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। কোনও চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল না। সবাই মাঠে বসেই দেখলেন। ছবি চলাকালীন দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া শুনতে আমার অপূর্ব লাগছিল, যা পরবর্তী কালে আমার চিত্রনাট্য লেখায় কাজে এসেছে। মাঝে-মধ্যে হাওয়া দিচ্ছিল, আর পর্দাটা তিরতির করে কাঁপছিল। মানুষজন মন্ত্রমুগ্ধের মত ছবি দেখছিলেন। ধৈর্য ধরে পরের ছবির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পাঁচ-ছ’শো লোক হয়েছিল।

শুরু করেছিলাম সন্ধে ৭টা থেকে। রাত ১১টায় লোকজন কমে এসেছে। আমার হাতে তখনও গোটা চারেক ছবি রয়েছে। আমার এক দাদা এসে বললেন, ‘এ বার বন্ধ করে দে, লোকজন তো একেবারেই নেই।’ আমি মাথা গুনতে শুরু করলাম। দেখলাম, তখনও জনা ৭৫ দর্শক উপস্থিত (এখানে মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু কোনও পরিচিত নায়ক-নায়িকার ছবি দেখাইনি, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ছোট ছবি দেখিয়েছিলাম, এখনও তা-ই দেখাই)। তাঁরা বললেন, ‘তুই সিনেমা চালিয়ে যা ভাই, আমরা তো দেখছি!’

কলকাতায় স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র উৎসবে (নন্দন ব্যতীত অন্য জায়গায়) ৭৫ জন এলে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ‘হাউসফুল’ বলি। তার মধ্যে বেশির ভাগই থাকেন পরিচালকের আত্মীয়-বন্ধুরা। নিজেদের ছবি শেষ হলে উঠে চলে যান। এই ঘটনাটা বলছি, কারণ চলচ্চিত্র উৎসব শহরের লোককে যে শিক্ষা বা বোধ বা ভাল লাগা দেয়, গ্রামের লোককেও ততটাই দিতে পারে। তাঁরাও ভাল ছবি দেখলে ঠিকঠাক ‘অ্যাপ্রিশিয়েট’ করেন।

চলচ্চিত্র উৎসবের পরিসরকে তাই শুধু কলকাতা বা মফস্সলের সদর শহরে বেঁধে না রেখে গ্রামেও ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। উৎসবে জনপ্রিয় ছবি দেখানোর দরকার নেই, দীর্ঘকালীন মেয়াদে স্থানোপযোগী ঠিকঠাক ছবি নির্বাচন করে দেখিয়ে চলচ্চিত্র উৎসবকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারলে আখেরে সিনেমারই লাভ। দর্শকের, নির্মাতারও।

পুনশ্চ: এই ধরনের উদ্যোগে মাসি, পিসি, বাবা-মা, দাদা, কাকা, বন্ধুবান্ধব, পাড়ার লোক সবাইকে সামিল করতে পারলে কিন্তু সাফল্যের সম্ভবনা অনেক বেশি। আর খরচের কথা যদি বলেন, প্রাথমিক ভাবে সর্বজনীন পুজো যে ভাবে চাঁদা তুলে করা হয় সেই ভাবেই চলচ্চিত্র উৎসব হবে (আজকাল কম খরচায় ছবি দেখানোর সুযোগ অনেক বেশি, এ ভাবে দেখালে পরিচালক বা প্রযোজকেরা খুব একটা আপত্তি করেন না দেখেছি)। আগে চাহিদা তৈরি হোক, তার পরে না-হয় টিকিট বিক্রি করা যাবে।

লেখক চিত্র পরিচালক ও সম্পাদক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement