প্রতীকী ছবি।
তালাক, তালাক, তালাক! তার পরে?
সে কথা জানেন টগর। সে আগুনে পুড়েছেন নাসিমা, ফতেমা। সে আগুনে পুড়ছেন আরও কত মেয়ে। কে তাদের খবর রাখে!
সে-ও এমনই এক শ্রাবণবেলা ছিল। পর পর দুই মেয়ে। শ্বশুরবাড়ি তো বটেই, বাপের বাড়ির লোকজনও বলাবলি করতেন, এ বার নির্ঘাৎ উপরওয়ালা মুখ তুলে চাইবে। টগরের কোল আলো করে এ বার ছেলে আসবে। টগর সে কথায় রা কাড়তেন না। তাঁর ভয় করত। যদি এ বারেও...।
সরকারি হাসপাতালের ‘লেবার রুমের’ বাইরে এক রাশ উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি-ননদ, বাবার বাড়ির লোকজন। হাসপাতাল চত্বরে পায়চারি করছেন স্বামী হজরত শেখ।
হাসিমুখে বাইরে এলেন নার্স, ‘যান, দেখে আসুন!’ স্বামী শুধোলেন, ‘ও টগর ছেলে নাকি!’
শাশুড়ি ছুটে এলেন, ‘কই, নাতির মুখ দেখি।’
সদ্যোজাতকে দেখে পিন পড়ার স্তব্ধতা। গুটিগুটি পায়ে যে যার মতো চলে গেলেন। টগর তার পরেও দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু কেউ খোঁজ নেননি। ফুটফুটে মেয়ে হওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি টগর। বুকের মধ্যে ক্রমশ ডালপালা ছড়াচ্ছিল ভয়। হজরত এক দিন এসেছিলেন। তবে দাঁড়িয়েছিলেন দূরে। কাছে আসেননি।
টগরের শাশুড়ি পাড়া মাথায় করেছিলেন, ‘‘এ জন্মে কি আর তা হলে নাতির মুখ দেখতে পারব না?’’ পড়শি রেহেনা বিবি ফোড়ন কাটেন, ‘‘কী আর করবে বলো, সবই নসিব!’’ নসিবই বটে! হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যেই বেলডাঙার টগর বিবিকে শুনতে হল— ‘তালাক, তালাক, তালাক!’ তিন মেয়েকে নিয়ে ঘর ছাড়লেন টগর!
টগরের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। ভাইদের নিজেদের সংসার রয়েছে। তাঁরা পরের জমিতে খেটে খান। বোনকে তাঁরা ঘরে তুললেন না। অসহায় টগর সন্তানদের নিয়ে গিয়ে ওঠেন মামার বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও দিবারাত্রি খোঁটা আর খোঁটা। সারা বাড়ির কাজ করেও কারও মন পান না তিনি। ঠিকমতো খাবার জোটে না। ছোট মেয়েটা আবার খিদে সইতে পারে না। খিদে পেলেই কাঁদে। টগর আদর করে নাম রেখেছিলেন গোলাপি। গোলাপি কাঁদলেই তার গাল লাল হয়ে ওঠে—‘মা ভুখ লেগিছে। খাতি দাও।’
সে কথা শুনে টগরের বুক ফাটে। নিজের উপরেই বড় রাগ হয়। টগর চিৎকার করেন, ‘‘সারা দিন এত খাওয়া-খাওয়া করিনি, পাবু কুথায়! বুঝিস না ক্যানে!’’
পড়শি এক ফুফু থাকে দিল্লিতে। ইদে কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে। তার কাছেই নিজের দুঃখের কাহিনি মেলে ধরেন টগর। ফুফু কথা দেয়, সে টগরের সব দুখ ঘুচিয়ে দেবে। মামার বাড়িতে ফুটফুটে তিন মেয়েকে রেখে কাজের সন্ধানে দিল্লি চললেন টগর।
কিন্তু সেখানেও বিপদ! পরিচারিকার কাজ দেওয়ার নাম করে টগরকে বিক্রির চেষ্টা করে সেই ফুফু। বিপদ আঁচ করে কোনও রকমে পালিয়ে গাঁয়ে ফিরে আসেন টগর। তার পরে স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে ঢুকে আর্থিক হাল ফেরে তাঁর।
তখনও তিন তালাক বিল আসেনি। সেই সময়ে টগর বলছিলেন, “জানেন, আমার বাবাও মাকে তালাক দিয়েছিল। মা কষ্ট করে আমাদের মানুষ করে। আমার এমনই দুর্ভাগ্য, মায়ের জীবনে যা ঘটেছে, সেই একই ঘটনা আমার
জীবনেও ঘটল!’’ টগরদের জীবনে দুর্ভাগ্যও এ ভাবে ফিরে ফিরে আসে! শুধু তিল তালাক বিলটা পাশ হতেই যা একটু সময় লেগে যায়!