সিমেন্টের রাস্তার পাশে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন একাশি বছরের ননীবালা বিশ্বাস। স্মৃতি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবুও সেই দিনটার কথা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। যে দিন সিপিএমের লোকেরা জমির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, “এ বার থেকে তোমরা এখানেই থাকবে। এটা তোমাদের জমি।”
সেটা ছিল ১৯৭৮ সাল। রাজার পুকুরের পাশের সেই জমি কিন্তু এখনও খাতায়কলমে তাঁদের হয়নি। থেকে-থেকে বুকের ভিতরে এখনও ভয় চেপে বসে এখানকার মানুষের। কেউ তুলে দেবে না তো? জমির তো কোনও কাগজ নেই। ননীবালা চার দিক ভাল করে দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলেন, “সেই কবে থেকে শুনে আসছি, সরকার আমাদের নামে জমিটা লিখে দেবে। কত বার মাপজোক হল। কত বার টাকা দিতে হল। জমি পেলাম না। এ বার যদি অপেক্ষার দিন শেষ হয়!”
দোলাচলে ভুগছেন শ্রীকৃষ্ণ কলোনির প্রত্যেকে। সকলেই জানতে চান, “সত্যিই জমি এ বার আমাদের নামে হবে তো?” তাঁদের অভিযোগ, সিপিএমের আমলে অনেক বার তাঁদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, জমি মাপা হয়েছে। ভোট এলে বলা হয়েছে, “আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। আরেকবার বামফ্রন্টকে জেতাও। এ বার ঠিক জমি তোমাদের হয়ে যাবে।” শর্ত হল মিছিলে যেতে হবে। জমির স্বপ্ন দেখতে-দেখতে তাঁরা সিপিএমের মিছিলে হেঁটেছেন। কিন্তু অপেক্ষা শেষ হয়নি।
কলোনির প্রায় সকলেই দিনমজুর। কেউ-কেউ ভ্যান চালান। অভাব প্রকট প্রায় সব পরিবারে। স্থানীয় বাসিন্দা নিখিল সরকার বলেন, “আমাদের সব দলই ভোটের আগে কলা দেখায়। বলে, ‘জমি হয়ে যাবে, আগে ভোটটা দাও।’ আমরা জমির স্বপ্নে ভোট দেই। কিন্তু পায়ের নিজের মাটিটা আর আমাদের হয় না।”
তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বাস্তু কলোনির জমির মালিকানা সত্ত্ব বাসিন্দাদের দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পরেও অনিশ্চয়তা দূর হয় না তাঁদের। স্থানীয় বাসিন্দা বরুণ মজুমদার বলেন, “আনন্দ হচ্ছে, আবার ভয়ও লাগছে। শেষ পর্যন্ত হবে তো? যখন সিপিএম ছিল তখন জমি পাব বলে বেশ কয়েক বার দুশো-পাঁচশো করে টাকা দিয়েছি। এ বার জমির দলিল পেলে কেউ আর আমাদের উচ্ছেদ করতে পারবে না।” শ্রীকৃষ্ণ কলোনি থেকে হাঁটা পথে দশ মিনিট গেলেই বগুলা পুরাতন পল্লি। সেখানে থাকেন বাম সরকারের উদ্বাস্তু, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের প্রাক্তন মন্ত্রী বিনয় বিশ্বাস। তার আগে একই দফতরের মন্ত্রী ছিলেন হাঁসখালির বাসিন্দা নয়ন সরকার। এলাকা থেকে দু’জন মন্ত্রী পাওয়া সত্ত্বেও কেন বাম আমলে তাঁরা জমির সত্ত্ব পেলেন না?
বিনয়বাবু বলেন, “কী কারণে যেন করা যায়নি। ঠিক মনে পড়ে না।” মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা করছেন শুনে বিনয়বাবুর মন্তব্য, “কাজটা যেই করুন, ভাল কাজে শুভেচ্ছা রইল। (শেষ)