মায়াপুর ফাঁকা, সুনসান হাজারদুয়ারি

বাঙালি মানেই পায়ের তলায় সর্ষে। শীত পড়তে না পড়তেই বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়া। সে দূরেই হোক কিংবা কাছে-পিঠে ইতিউতি। কিন্তু এ বার সে সব কোথায় কী? রাস্তাঘাটে ভিড় নেই, হোটেলের ঘর ফাঁকা, ‘গাইড লাগবে নাকি’— এমন প্রশ্ন নিয়ে উৎসাহী মুখের আনাগোনা নেই।

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:৫৪
Share:

নোটের আকালে পর্যটকের আকাল হাজারদুয়ারীতে। ছবি- গৌতম প্রামানিক

বাঙালি মানেই পায়ের তলায় সর্ষে। শীত পড়তে না পড়তেই বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়া। সে দূরেই হোক কিংবা কাছে-পিঠে ইতিউতি।

Advertisement

কিন্তু এ বার সে সব কোথায় কী? রাস্তাঘাটে ভিড় নেই, হোটেলের ঘর ফাঁকা, ‘গাইড লাগবে নাকি’— এমন প্রশ্ন নিয়ে উৎসাহী মুখের আনাগোনা নেই। মায়াপুর কিংবা নবদ্বীপ মন্দিরের চাতাল, বেথুয়াডহরির সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি... খা খা করছে সবই। পলাশীর প্রান্তর থেকে হাজারদুয়ারি, মতিঝিল, ছবিটা প্রায় সর্বত্র একই রকম।

ব্যাপারটা যে আক্ষরিক অর্থেই সত্যি, মেনে নিচ্ছেন ‘ফেডারেশন অব বেঙ্গল হোটেলিয়ার্স’-এর রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিৎ সরকার। জানালেন, অন্য বারের তুলনায় এ বছর শীতে পর্যটকের আনাগোনা অর্ধেকেরও কম। হোটেলে ঘর বুকিংয়ের ফোন আসাও প্রায় বন্ধ। তাঁর কথায়, “আরে মশাই, লোকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে, নাকি বেড়াতে যাবে, সেটা আগে বলুন তো? মাস পোহালেই প্রত্যেক বাড়িতেই একগুচ্ছ খরচ। কাজের লোকের মাইনে থেকে ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন। আগে সে সব সামলাবে, তবে না বেড়াতে যাবে। হাতে নগদ টাকা যে একদম নেই।” প্রসেনজিৎবাবুর আশঙ্কা, নোট-সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে অনেক ছোট-বড় হোটেলেরই ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

Advertisement

মুর্শিদাবাদের লালবাগের একটি নামী হোটেলের মালিক আশিস রক্ষিতই যেমন বললেন, ‘‘আমার হোটেলের ৪২টি ঘরের মধ্যে ৪টি ঘরে পর্যটক রয়েছেন। বাকি ঘরগুলি ফাঁকা পড়ে।’’ উপরন্তু বড়দিনের ছুটিতে আগেভাগে হোটেলের ঘর বুকিং করে রেখেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন। আবার এমন নজিরও আছে যে, বুকিং ছিল বলেই বাধ্য হয়ে বেড়াতে এসেছেন। তার পর ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ে কার্ডে বিল মেটাতে গিয়ে দেখছেন, ব্যাঙ্কের লিঙ্ক নেই। ফলে কার্ডও কাজ করছে না। বাধ্য হয়েই তখন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোটেল ছাড়ছেন পর্যটকেরা। এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকছে না হোটেল মালিকদেরও।

পর্যটকেরা যে সত্যিই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, হাজারদুয়ারির টিকিট বিক্রির হিসেব দেখেলেই টের পাওয়া যায়। গত নভেম্বর জুড়ে মাত্র আড়াই হাজার পর্যটকের ভিড় হয়েছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে সেই ভিড় ছিল প্রায় ১৫ হাজারের কাছাকাছি।

পর্যটকদের গাড়ি-পিছু কর আদায় করে থাকে মুর্শিদাবাদ পুরসভা। কিন্তু এ বার কর আদায়েও ধাক্কা লেগেছে। পুরপ্রধান বিপ্লব চক্রবর্তী জানান, গত বছর নভেম্বরে চার লক্ষ টাকা আদায় হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও কর আদায় হয়নি এ বছর। পাঁচশো-হাজারের ঝামেলায় টোল আদায়ই যে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে লেভি আদায়ের কাউন্টার খুলে রেখেও লাভ হচ্ছে না।

পর্যটন নির্ভর নবদ্বীপের ব্যবসা বানিজ্যের কথা বলতে গিয়ে নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাসও বলেন, “গত একমাসে ব্যবসার হাল খুব খারাপ। সামনে বড়দিন, নিউ ইয়ারের মতো মরশুমের মুখে মহাজন খুচরো ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন করছেন— ‘নতুন নোট পেয়েছেন তো। তবেই মাল কিনতে আসবেন। না হলে আসবেন না’। সুতরাং কী অবস্থায় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন, বুঝতেই পারছেন।’’ কিছুটা দুঃখ করেই জানালেন, এই সময় শহরজুড়ে বহিরাগত পর্যটকের ভিড়ে দোকান-বাজার-হোটেল-লজ-অতিথিশালা থিকথিক করে। সেখানে এ বার সব কিছু সুনসান। অনেক দোকনে সারা দিনেও বউনি হচ্ছে না।

মায়াপুর ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “অন্য বারের তুলনায় ভিড় একেবারে অর্ধেক। জানি না বড়দিন কিংবা নিউ ইয়ারে ছবিটা বদলাবে কি না।”

এ প্রসঙ্গে ‘নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি’-র সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহা বলেন, “পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যাঁরাই জড়িয়ে রয়েছেন, তাঁদের প্রায় নাভিশ্বাস উঠার জোগাড়। সাধারণ মানুষ যদি স্বাভাবিক লেনদেন করতে না পারেন, তা হলে ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা আসবে কী করে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement