প্রতীকী ছবি
যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থানার করিডরে লাইন দিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন মানুষ, সেখানে থানা চত্বর বিলকুল ফাঁকা। পুলিশকর্মীদের যেখানে ছাড়া দেখা নেই কারও। পুলিশকর্মীদেরও যেখানে একের পর এক অভিযোগ নিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেই মুর্শিদাবাদ জেলায় এখন থানার চেহারাটা একেবারেই উল্টো। পুলিশকর্মী ছাড়া দেখা নেই কারও, এমনকি অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও যে থানা চত্বরে দেখা যেত, তাঁদেরও আর পা পড়ছে না থানা প্রাঙ্গণে। অপরাধের তালিকাটা প্রায় শূন্য, পুলিশকে এখন কেবলই মানুষকে ঘরমুখো করতে মাঠে নামতে হচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা। অবস্থা এমনই যে, জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘মানুষ যদি লকডাউনটা নিজেরা মেনে নিত, তা হলে এই সময়ে আমাদের টেবিলে মাথা রেখে ঘুমানো ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না।’’
করোনাভাইরাসের জন্য লকডাউনের সময় অপরাধের রেখাচিত্র এখন এ ভাবেই নেমে গিয়েছে মুর্শিদাবাদে। অথচ, থানা আর রেশন দোকানের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না জেলার অনেক জায়গাতেই। যেমন ডোমকলে সূর্য ওঠার পর থেকেই অভিযোগ দায়েরের লাইন পড়ে থানার সামনে। আর এখন সেই থানায় ডিউটি অফিসারের সামনে টেবিলটা একেবারে ফাঁকা। কেবল ডোমকল নয়, গোটা জেলা জুড়ে খাঁ খাঁ করছে থানা চত্বর। থানার সামনে চায়ের দোকানেও মাছি ভন ভন করছে সকাল থেকে সন্ধ্যা। পুলিশ কর্তারা বলছেন, কেবল লকডাউন নয়, করোনা আতঙ্কটা ছড়ানোর পর থেকেই অপরাধের তালিকাটা একেবারে নেমে এসেছে নীচের দিকে। প্রায় দিন পনেরো থেকেই থানায় সাধারণ মানুষের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে।
সীমান্তের যে থানা সকাল থেকে সন্ধ্যা গমগম করে, সেই রানিনগর থানার অবস্থাও এখন একই রকম। গত এক সপ্তাহে সেখানে মেরে কেটে তিনটে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, কান্দির বড়ঞা থানায় যেখানে দিনে ৩০ থেকে ৪০টা অভিযোগ দায়ের হত, সেখানে গত তিন দিনে মাত্র ছ’টা জেনারেল ডায়েরি হয়েছে। ওই এলাকার খড়গ্রাম ভরতপুর সালার এলাকাতেও ছবিটা একই রকম। কান্দির আইসি অরূপ রায় বলছেন, ‘‘থানা চত্বরের এমন চেহারা চাকরি জীবনে কখনও দেখিনি। দিনভর লকডাউন নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি বিভিন্ন এলাকায়।’’ পুলিশকর্তারাই জানাচ্ছেন, লকডাউনে চলাফেরা করার উপরে নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনেকে আবার ইচ্ছে করলেও থানায় যেতে পারছেন না। তাই জমি নিয়ে গোলমালের যে চিত্র এই জেলায় প্রায় রোজ লেগে থাকে, সেই গোলমাল আর থানা পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। কারও মোবাইল বা অন্য জিনিসপত্র চুরি গেলেও থানায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ মানুষই সে সব গুরুত্বও দিচ্ছেন না।
কিন্তু সেই সঙ্গেই একটি বড় কথা হল, মানুষ েখন বাড়িতেই থাকছেন। তাই চুরি ডাকাতির সাহসও কোনও সমাজবিরোধী দেখাতে পারছে না। দুষ্কৃতীদের আনাগোনা কমে গিয়েছে, কেননা, সব রাস্তায় কড়াকড়ি রয়েছে। যে কেউ রাস্তায় নামলেই পুলিশের নজরে ধরা পড়ছেন। তাই অস্ত্র পাচার তো দূরের কথা, দুষ্কর্ম করে অন্য জেলা বা রাজ্যে পালিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা এই জেলায় রয়েছে, তা এখন একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। তাতেই কমেছে জেলার অপরাধ। খোদ জেলা সদর বহরমপুর থানায় ১৫ মার্চ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত ৩৩টি এফআইআর দায়ের হয়েছিল, সেখানেই গত ২২ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত এফআইআর হয়েছে মাত্র পাঁচটি। ফলে এখান থেকেই ছবিটা প্রায় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে গোটা জেলার। এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘এখন সবার অবস্থা চাচা আপন জান বাঁচা, ফলে আর কেউ কোনও গন্ডগোলের মধ্যে যেতেও পারছে না। লকডাউনের জন্য যাওয়া সম্ভবও হচ্ছে না।’’ যারা সীমান্তে দাপিয়ে বেড়ায় সেই পাচারকারীরাও একই আতঙ্কে একেবারে ঘরে ঢুকে গিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রেই খবর।
তথ্য সহায়তা: বিমান হাজরা, কৌশিক সাহা, বিদ্যুৎ মৈত্র