দেখা নেই ক্রেতার। নবদ্বীপে। নিজস্ব চিত্র
রবিবারের সকাল ১০টা। কৃষ্ণনগরের গোয়ারি বাজার। পাইকারি মাছ বাজারে আড়তদারের ঘরের সামনে ডাঁই করে রাখা রিটে, ভোলা মাছ ভরা বাক্স। বিক্রি নেই। লোকে খাচ্ছে না। অথচ সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছবিটা ছিল অন্য রকম। সাত সকালেই বিকিয়ে যেত সমুদ্রের মাছ।
পাইকারেরা জানাচ্ছেন, গুজব রটেছে সামুদ্রিক মাছ থেকে নোভেল করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, মুখে মুখেও ছড়াচ্ছে সেই গুজব। সেই গুজবের জেরে তলানিতে এসে ঠেকেছে সামুদ্রিক মাছের বিক্রি। ফলে মাথায় হাত আড়তদার থেকে খুচরো মাছ বিক্রেতাদের। বিক্রি না হওয়ায় বরফ দিয়ে মাছ তুলে রাখছেন আড়তদারেরা। কিন্তু সেই মাছ আদৌ বিক্রি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে তাঁরা।
গোয়ারি বাজারের এক আড়তদার রফি দফাদারের কথায়, ‘‘কিলোগ্রাম প্রতি ২০ টাকা ক্ষতি করে ভোলা-রিটে মাছ বিক্রি করছি। তাও খুচরো বিক্রেতারা মাছ কিনতে চাইছেন না।’’
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন খুচরো মাছ বিক্রেতা বিধান মল্লিক। গোয়ারি বাজার থেকে মাছ কিনে দোগাছি, জালালখালিতে সাইকেলে চেপে ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করেন। তিনি জানান, সস্তা হওয়ায় গ্রামের লোকজন সামুদ্রিক মাছ কিনতেন। একটা গ্রাম ঘুরলে কয়েক কিলোগ্রাম রিটে, ভোলা বা সার্ডিন মাছ বিক্রি হয়ে যেত। তখন রিটে মাছ বিক্রি করেছেন ১৪০ টাকা কিলোগ্রাম দরে। তিনি বলেন, ‘‘এখন ৯০ টাকা কিলোগ্রাম দরেও কেউ কিনতে চাইছেন না। ১৩০ টাকার ঢেলা মাছ ৮০ টাকায় নেমে এসেছে। ১০০ টাকার চমচম ভোলা ৬০ টাকা কিলোগ্রাম দরে বেচতে গিয়েও কেনার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।’’
ব্যবসায়ীরাই জানাচ্ছেন, পমফ্রেট আর বেজি ভোলার মতো সামুদ্রিক মাছের দাম কমেনি বটে, তবে চাহিদা কমেছে। সামুদ্রিক মাছের বদলে চালানে রুই, কাতলা বা জ্যান্ত মাছ খাওয়ার দিকে মানুষের ঝোঁক বেড়েছে। দামও বেড়েছে জ্যান্ত মাছের। ১০০০ টাকার ট্যাংরা বিকোচ্ছে হচ্ছে ১২০০ টাকা কিলোগ্রাম দরে। ৫৮০ টাকার তোরা মাছের দাম বেড়ে হয়েছে ৬২০ টাকা। কিলোগ্রাম প্রতি ২০ থেকে ৭০ টাকা মতো দাম বেড়েছে রুই, কাতলার।
নবদ্বীপের তিওরখালি গ্রামের মাছ বাজারে দুপুর ১টার সময়ও খান কয়েক ফ্যাসা, রিটে নিয়ে বসেছিলেন গফুর শেখ। গফুর বলেন, ‘‘দিন কুড়ি আগেও ১৫০ টাকা কিলোগ্রাম দরে ফ্যাসা বা রিটে বিক্রি করেছি। রবিবারের বাজারে তো সাতসকালেই সে সব মাছ বিক্রি হয়ে যেত। আজ ৮০ টাকা কিলোগ্রামে রিটে, ৬০ টাকা কিলোগ্রামে ফ্যাসা বিক্রি করছি। তাও লোক পাচ্ছি না কেনার। তাই বাধ্য হয়ে বাটা আর চালানে রুই তুলেছি।’’ এখন ১২০ টাকার বাটা মাছ ২০০ টাকা হয়েছে। গফুর বলেন, ‘‘উপায় কি? ঝুঁকি নিয়ে বেশি দামের বাটা নিতে হল। কারণ, চারাপোনার বাজার রিটে-ভোলার থেকে অনেক ভাল।’’
তবে সমুদ্রের মাছ নিয়ে এই অহেতুক ভীতির কোনও কারণই দেখছেন না বিশেষজ্ঞেরা। সিঙ্গুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তথা মৎস্যবিদ দেবজ্যোতি চক্রবর্তী যেমন বলেন, ‘‘মাছের দেহে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়ার কোনও খবর এখনও পর্যন্ত নেই। এমনকি, মাছ থেকে কোনও ভাইরাসঘটিত রোগ মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছে তেমন কোনও তথ্যও পাওয়া যায়নি। বরং সামুদ্রিক মাছ থেকে যে ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায় তা হার্টের পক্ষে খুব ভাল।’’
তিনি এও জানান, এমপিইডিএ (মেরিন প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটি) সামদ্রিক মাছ রফতানি বা খাওয়ার ব্যপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। তাই তা না-খাওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না।