প্রশ্নটা শুনেই চমকে উঠেছিলেন রানাঘাট মহকুমা সংশোধনাগারের সাব-জেলর সমর পাল।
“স্যার কিটসের কবিতার বই হবে? বাংলা অনুবাদ।”
প্রশ্নটা শুনে চোখ তুলে তাকাতেই দেখেন টেবিলের ও পারে বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক। খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত। বিচার চলছে।
এই ভাবেই গত ক’মাসে বারবার চমকে উঠেছেন সমরবাবু। গাংনাপুরে এক অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলায় বিচারাধীন আবাসিক চেয়েছিলেন ডেল কার্নেগির ‘নতুন জীবনের ঠিকানা।’ রাতের রাউন্ডে বেড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১২টা নাগাদ তিনি দেখেন, ওয়ার্ডে বসে এক মনে শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ পড়ছেন যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া এক আবাসিক।
গত ৩১ অগস্ট সাধারণ গ্রন্থাগার দিবসে কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগার এবং তেহট্ট মহকুমা সংশোধনাগারে ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগারের মাধ্যমে বই সরবরাহ করা শুরু হয়েছে। পরে একে একে রানাঘাট ও কল্যাণী মহকুমা সংশোধনাগারেও তা চালু হয়। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শরৎচন্দ্রের ‘পল্লিসমাজ’, ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবি’, আশাপূর্ণা দেবীর ‘লঘু ত্রিপদী’ প্রতিভা বসুর ‘লাবণ্য লেখা পালিত’-এর মতো বেশ কিছু বই।
কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারের এক আবাসিক চেয়ে বসলেন ‘সেই সময়’। সমরেশ বসুর ‘অশোক ঠাকুর সমগ্র’, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, সুচিত্রা মিত্রের ‘উড়ো মেঘ অলীক মুখ’ ও ‘একা জীবন’, বুদ্ধদেব গুহর ‘ধুলো বালি’, বনফুলের ‘দ্বৈরথ’, অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, নীলমণি চক্রবর্তীর ‘প্রসঙ্গ পুণ্য’, বাণী বসুর ‘চালসার ডায়েরি’ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘সাঁঝের প্রদীপ’, আগাথা ক্রিস্টির ‘রাতের চোখে মৃত্যু ঘুম’— চাওয়ার তালিকা দীর্ঘ। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও প্রবন্ধের চাহিদাও যথেষ্ট।
জেলা গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক অংশুমান দে বলেন, “যত দিন যাচ্ছে চাহিদা বদলে বদলে যাচ্ছে। ক্রমশ সিরিয়াস আর আধুনিক লেখকদের চাহিদা বাড়ছে। আমরা তো প্রথম দিকে ভাবতেই পারিনি।”
জেলার চারটি সংশোধনাগারের ভিতরে সবচেয়ে বেশি বইয়ের চাহিদা রানাঘাটে। ‘ফেলুদা’ থেকে সৈয়দ মুজতবা সিরাজের ‘রেনবো অর্কিড রহস্য’, শরদিন্দু অমনিবাস, শক্তিপদ রাজগুরুর ‘কিছু ভালবাসা’, প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘রত্নদ্বীপ শ্রীলঙ্কা’। তুঙ্গে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের উপন্যাসের চাহিদা। এমনকী শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বইয়েরও।
বেশ কিছু আধ্যাত্মিক বইয়ের চাহিদাও রয়েছে। রানাঘাটের সাব- জেলর সমর পাল বলেন, “বইয়ের জন্য আবাসিকদের এই চাহিদা দেখে আমাদেরও ভীষণ ভাল লাগছে।” প্রথম দিন কৃষ্ণনগর সংশোধনাগারের আবাসিকেরা যেখানে মাত্র ১৭টা বই নিয়েছিলেন, সেটাই এখন বেড়ে মাসে ৪০ থেকে ৫০-এ দাঁড়িয়েছে। আর রানাঘাটে পাঁচটা দিয়ে শুরু করে এখন মাসে প্রায় ৭০টা। গ্রন্থাগারিকেরা মনে করছেন, আগামী দিনে বইয়ের চাহিদা আরও বাড়বে।