কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল। নিজস্ব চিত্র
আগেও প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে সহ-শিক্ষকদের একাংশের বিবাদ বারবার সামনে এসেছে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে। এ বার শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা করা নিয়ে আবারও বিবাদ বেধেছে। এ বার প্রায় সমস্ত শিক্ষকই প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলে স্কুল সূত্রের খবর। সরকারি স্কুলে এই টানাপড়েনে প্রশাসন থেকে শুরু করে অভিভাবকেরা বিরক্ত।
রাজ্য শিক্ষা দফতরের নির্দেশ হল, কোনও সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষকেরা প্রাইভেট টিউশন করতে পারবেন না। গত বছরেও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েটে শিক্ষকদের এই মর্মে লিখিত বিবৃতি দিকে বলা হয়েছিল। সকলে তা দিয়েওছিলেন। কিন্তু এ বার তাঁরা বেঁকে বসেছেন। কেউই লিখিত বিবৃতি দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এর পরেই প্রধান শিক্ষক দিবা বিভাগের ১৭ জন ও প্রাতর্বিভাগের পাঁচ জনকে শো-কজ় করেন। তাতেই বিরোধ নতুন করে উসকে উঠেছে।
নদিয়া জেলার মাধ্যমিক শিক্ষা পরিদর্শক ব্রজেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকারি নির্দেশে এমনটা বলা নেই যে লিখিত বিবৃতি নিতেই হবে। কিন্তু যেহেতু স্কুলশিক্ষকদের টিউশন করা নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে, নানা জায়গায় বিতর্ক হচ্ছে, সেই কারণেই লিখিত বিবৃতি চাওয়া হচ্ছে। অন্য জেলাতেও এটা হচ্ছে।’’
কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষকদের পাল্টা বক্তব্য, তাঁরা জেলা স্কুল পরিদর্শকের নিয়ন্ত্রণাধীন নন, সরাসরি রাজ্য শিক্ষা দফতরের অধীনস্থ। শিক্ষা দফতর লিখিত বিবৃতি নেওয়ার কোনও বিজ্ঞপ্তি বা নির্দেশিকা দেয়নি। সেই কারণেই এ বছর তাঁরা তা দেননি। তাঁদের কার্যত সমর্থন করে রাজ্যের সরকারি স্কুল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু বলেন, ‘‘সরকারি চাকরির শর্তই হল, আমরা অন্য কোনও লাভজনক কাজ করতে পারব না। এর পরে আবার এই মর্মে লিখিত বিবৃতি চাওয়া অপ্রয়োজনীয়। এবং তা না দেওয়ায় শো-কজ় করাও অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ।’’
তা হলে গত বছর শিক্ষকেরা লিখিত বিবৃতি দিয়েছিলেন কেন?
সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি পশ্চিমবঙ্গ-র কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল ইউনিট সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, “গত বছর সমস্ত শিক্ষক যে লিখিত বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তা নিয়ে বাইরে পোস্টার পড়েছিল।” তাঁর মতে, ‘‘আসলে প্রধান শিক্ষকের উদ্দেশ্য হল সহশিক্ষকদের হেনস্তা করা, অপমান করা। সরকারি নির্দেশ এলে অবশ্যই লিখিত বিবৃতি দেওয়া হবে।”
এই টানাপড়েনের পিছনে কারণ হিসেবে রয়েছে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বাকিদের সম্পর্ক বিষিয়ে যাওয়াও। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ওই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন মনোরঞ্জন বিশ্বাস। তার পর থেকেই পড়ুয়াদের পোশাক থেকে শুরু করে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের উপকরণ কেনা নিয়ে সহ-শিক্ষকদের একাংশের সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাধে। তার পর টিউশন না-করা সংক্রান্ত লিখিত বিবৃতি চাওয়ায় সহশিক্ষকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন।
প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন বিশ্বাস অবশ্য শুক্রবারও দাবি করেন, ‘‘আমি সরকারি নির্দেশিকা মেনেই শিক্ষকদের লিখিত বিবৃতি দিতে বলেছিলাম।” কেউই তো তা দেননি, ২২ জনকে শো-কজ় করা হল কেন? প্রধান শিক্ষকের ব্যাখ্যা, “গৃহশিক্ষকদের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েক জন শিক্ষকের নাম দিয়ে জানানো হয়েছিল যে তাঁরা প্রাইভেট টিউশন করেন। আমি তাঁদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করেছি, তা-ও তাঁরা তথ্য জানার অধিকার আইন (আরটিআই) মোতাবেক জানতে চান। সেই মতো খোঁজ নিয়ে যাঁরা গৃহশিক্ষকতা করছেন বলে জানতে পেরেছি, তাঁদেরই শো-কজ় করেছি।”
এই টানাপড়েনের ফলে স্কুলের পঠনপাঠনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষকই। তাঁরা মনে করছেন, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে না পারলে স্কুলের পড়াশোনা তলানিতে পৌঁছে যাবে। সহকারী প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত মণ্ডলের মতে, “প্রধান শিক্ষক পদাধিকার বলে একক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। কিন্তু সকলের সঙ্গে কথা বলে স্কুল পরিচালনা করলে পরিবেশটা স্বাভাবিক থাকে।”
পদাধিকার বলে ওই সরকারি স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি নদিয়ার জেলাশাসক বিভু গোয়েল। একের পর এক বিতর্ক তৈরি হওয়ায় তাঁরাও বিরক্ত। এর আগেও একাধিক বার পরিচালন সমিতির বৈঠকে স্থায়ী সমাধানের কথা বলেছিলেন তাঁরা। তাতে কোনও লাভ হয়নি। এ দিন জেলাশাসক বলেন, “শিক্ষকদের টিউশন করাটা কোনও ভাবেই মানা হবে না। এর আগেও একাধিক বার পরিচালন সমিতির বৈঠকে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তার পরেও সমস্যা থেকে গিয়েছে। এ বার ফের পরিচালন সমিতির বৈঠক ডেকে কড়া পদক্ষেপ করব।”