দুর্ঘটনার পর দুমড়ে যাওয়া গাড়ি।
ফের সচেতনতার অভাব। ফের কানে হেডফোন। এবং ফের মৃত্যু।
তবে এ বার হেঁটে নয়, গাড়ি চালিয়ে প্রহরীহীন রেলগেট পেরোতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হল চালক রতন মণ্ডলের (২২)। গুরুতর জখম হয়েছে টুবাই সরকার ও রেন্টু মণ্ডল নামে দুই কিশোর। তারা জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মৃত ও আহতেরা সকলেই জঙ্গিপুরের খুড়িপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব রেলের আজিমগঞ্জ – ফরাক্কা শাখার গণকর ও জঙ্গিপুর রোড স্টেশনের মাঝে খুড়িপাড়া গ্রামেই।
সময়ের চেয়ে জীবনের দাম বেশি। মোবাইল কানে রেললাইন পেরোবেন না। সচেতনতা বাড়াতে রেল মন্ত্রকের এমন বিজ্ঞাপন হামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু তারপরেও সচেতনতা যে সে ভাবে বাড়েনি তা ফের প্রামাণ করে দিল এ দিনের দুর্ঘটনা। জঙ্গিপুরের স্টেশন ম্যানেজার সঞ্জীব কুমার বলেন, “আজিমগঞ্জ থেকে ৫৩৪৩৩ আপ আজিমগঞ্জ-বারহারোয়া প্যাসেঞ্জার ট্রেনটিকে জঙ্গিপুরে ঢোকার সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্টেশন থেকে মাইল খানেক উত্তরে খুড়িপাড়ায় ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। রেল লাইন পেরনোর ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবই এই দুর্ঘটনার কারণ।”
রেল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রতন যে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সেটি ভাড়া নিয়েছিল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক নির্মাণকারী সংস্থা। মাস দেড়েক থেকে গাড়িটি চালাতে শুরু করেন রতন। এ দিন রতন ওই সংস্থার কর্মীদের রঘুনাথগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে খুড়িপাড়ায় নিজের বাড়ি ফিরছিলেন। মিঞাপুরে রাস্তায় নিজের গ্রামের ওই দুই কিশোরকে দেখতে পেয়ে তিনি তাদের গাড়িতে তুলে নেন। গাড়ি নিয়ে তড়িঘড়ি খোলা রেল গেট পেরোতে গিয়েই এমন বিপত্তি।
শোকে ভেঙে পড়েছেন রতন মণ্ডলের পরিবার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাড়িতে জোরে গান বাজানো হচ্ছিল। চালক রতনের কানেও ছিল হেডফোন। সেই কারণে রেলগেটের কাছে এসেও ট্রেন ও ট্রেনের হুইসেলের শব্দ তিনি শুনতে পাননি। রেল গেট থেকে ১০ মিটার দূরে বাড়ি সন্ধ্যারানি মণ্ডলের। তিনি জানান, সকাল তখন ১০ টা হবে। আজিমগঞ্জের দিক থেকে হুইসেল দিয়ে ছুটে আসছে ট্রেন। ঠিক তখনই রতন গাড়ি নিয়ে সোজা রেলগেটের দিকে যাচ্ছিলেন। গেটের সামনে থাকা লোকজন বার বার চিৎকার করে তাঁকে বলেছিলেন—‘ ট্রেন আসছে রে, যাস না।’ কিন্তু সে কথা রতনের কানে বোধ হয় পৌঁছয়নি। গাড়িটি লাইনের উপর উঠতেই ট্রেনটি সজোরে ধাক্কা মারে গাড়িটিকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ট্রেনের ধাক্কায় গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে ছিটকে পড়ে প্রায় ৩০ মিটার দূরে মহাদেব মণ্ডলের চায়ের দোকানের মধ্যে। রেল লাইনের পাশে পড়ে ছিল রতনের নিথর দেহ। সেখান থেকে একটু দূরে পড়ে ছিল টুবাই। দুমড়ে যাওয়া গাড়ির মধ্যে ছিল রেন্টু। তাদের দু’জনকেই সঙ্গে সঙ্গে মোটরবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, ‘‘চায়ের দোকানটিতে সবসময় ভাল ভিড় থাকে। ভাগ্যিস এ দিন ঘটনার আধ ঘণ্টা আগেই দোকানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নাহলে আরও একটি বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটত।’’
এ দিন দুর্ঘটনার জন্য জঙ্গিপুর স্টেশনে প্রায় একঘন্টা আটকে থাকে গুয়াহাটি থেকে কলকাতাগামী গরিব রথ। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন রেলকর্মীরা। ফরাক্কা- আজিমগঞ্জ রেলপথে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেন এস মজুমদার। দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া প্রহরীহীন রেলগেটগুলি রেল মন্ত্রক ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন প্রহরীহীন গেটগুলিতে রেল মন্ত্রক ‘রেল মিত্র’ হিসেবে কর্মী নিয়োগ করেছে। খুড়িপাড়ার প্রহরীহীন রেল গেটেও একজন কর্মী আছেন। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় তিনি রেল গেটে ছিলেন না বলে জানা গিয়েছে। এ ব্যাপারে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।