বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো খুব একটা নেই। অথবা প্রাতিষ্ঠানিক বিয়েতে আপনার ঠিক বিশ্বাস নেই। লিভ টুগেদারের কথা ভাবছেন? জীবনের একটা সময়ে এমন কাউকে দরকার হয়, যার সঙ্গে দৈনিক সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া যায় অনায়াসেই। কিন্তু মাঝে মাঝে কাউকে কাছে পাওয়া আর একসঙ্গে এক ছাদের তলায় জীবন অতিবাহিত করার মধ্যে বিস্তর ফারাক।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছাদ মজবুত কিন্তু সম্পর্কে চিড় ধরেছে অজান্তেই। সেই চেনা মানুষটি যেন আর নেই। যার সঙ্গে হাসি-কান্না এক সুরে মেলার কথা ছিল, সে যেন হঠাৎ বদলে গিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিচ্ছেদ ধীর পায়ে দরজায় কড়া নাড়ে। আইনত বিয়ে হয়ে থাকলে ডিভোর্স। কিন্তু আপনি যদি লিভ টুগেদারে থাকেন, সে ক্ষেত্রে উপায়? কোনও আইনি সুরক্ষা আছে কি? ইউরোপের দেশগুলিতে লিভ টুগেদার নিয়ে কি আইনি ব্যবস্থা রয়েছে।
জার্মানি: জার্মানি আলাদা করে লিভ টুগেদারকে কোনও বিশেষ আইনের আওতায় আনেনি। শুধুমাত্র সমলিঙ্গের সম্পর্কের ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড পার্টনারশিপের কথা বলা হয়েছে। যেহেতু সামাজিক সুরক্ষাজনিত সুবিধাগুলি সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের জন্যই প্রযোজ্য, সেহেতু এখানে থাকতে গেলে আপনার সঙ্গীর সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় আগে থেকেই আলোচনা করে নিতে হবে। যেমন, পিতৃত্বের কথা নথিভুক্ত করতে হবে শিশুর জন্মের আগেই। আর অন্য সঙ্গী সেই তথ্যকে সমর্থন করবেন। এর সঙ্গেই জানাতে হবে যে বাবা না মা, ঠিক কার পদবী সন্তান পেতে চলেছে। বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য এখানে একটি বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য বিবাহিত-অবিবাহিতদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আয়করের ক্ষেত্রে অবিবাহিতদের আলাদা আলাদা আয়কর দিতে হবে। বিবাহিতদের মতো বিশেষ ছাড় পাওয়া যাবে না। জার্মানিতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিও আয়করের আওতায় পড়ে। বিবাহিত দম্পতির এক জন মারা গেলে অন্য জন যে সম্পত্তি পাবেন, তা পাঁচ লাখ ইউরো পর্যন্ত আয়কর মুক্ত। অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে যা শুধু মাত্র বিশ হাজার ইউরো।
নেদারল্যান্ডস: ডাচদের দেশে নিয়মকানুন খুব সহজ সরল। এখানে আপনি যদি অবিবাহিত সঙ্গীর সঙ্গে আসতে চান ও স্থায়ী ভাবে বসবাসের পরিকল্পনা করেন, তা হলে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনারা বহু দিন ধরে সম্পর্কে আবদ্ধ। নেদারল্যান্ডসে আপনি ও আপনার সঙ্গী সহবাস চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারেন। এ ছাড়াও এই দেশে রেজিস্টার্ড পার্টনারশিপ রয়েছে। একে বিবাহের সমতুল্যই ধরা হয়। যদি সহবাস চুক্তি করে থাকেন, তা হলে বাচ্চার জন্মের আগে জার্মানির মতোই আপনাকে পিতৃত্বের ঘোষণা করতে হবে। অন্তত সহবাস চুক্তি না থাকলে আপনি বিচ্ছেদের পরে নানা ধরনের অর্থনৈতিক দাবি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এই দেশে একসঙ্গে দু'জনে আয়কর দিতে পারেন আর সে ক্ষেত্রে মিলতে পারে বিশেষ ছাড়।
ইতালি: ইতালিতে লিভ টুগেদারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয় এই শর্তে যে, আবেদনকারী উভয়ের মধ্যে দৃঢ় মানসিক সম্পর্ক থাকবে। স্থানীয় পুরসভায় আপনাকে আপনার সম্পর্কের কথা নথিভুক্ত করতে হবে। যদিও এই আইন শুধুমাত্র ইতালির নাগরিকদের জন্য। বিদেশিরা তাঁদের নিজের দেশের সামাজিক আইন মানতে পারেন। সহবাস চুক্তি বা কোহ্যাবিটেশন কন্ট্রাক্টকে ইতালিতে বিবাহ-সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাই এই আইনে যাঁরা নথিভুক্ত হবেন, তাঁদের সন্তানরা সমস্ত সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাবে স্বাভাবিক ভাবেই। এ জন্য বিশেষ কোনও আবেদন করার প্রয়োজন নেই।
ফ্রান্স: কবিতার দেশ ফ্রান্স প্রতিনিয়ত সাক্ষী থাকে সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে অনেকেই সারাজীবন একসঙ্গে থাকার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। ফরাসিরা আবেগপ্রবণ। তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদি সম্পর্কে বিশ্বাসী কিন্তু আদবকায়দাও পছন্দ করেন বেশ। ফ্রান্সে লিভ টুগেদারের জন্য একটি সহজ-সরল সামাজিক ব্যবস্থা রয়েছে। ফরাসি ভাষায় লিভ টুগেদারকে বলা হয় ‘কনকুবিনেজ’। ফরাসি আইনের ৫১৫-৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যে কোনও লিঙ্গের দু'জন মানুষ যাঁরা দীর্ঘ সম্পর্কে রয়েছেন, তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারেন। তাঁরা যদি বিচ্ছেদ চান, সেটা কোনও আইনি পর্যায়ে পড়বে না। কিন্তু যদি কোনও রকম অশান্তি বা ঝগড়ার কারণে বিচ্ছেদ ঘটলে তাঁরা আইনি পথে হাঁটতে পারেন। ফ্রান্সেও রয়েছে রেজিস্টার্ড পার্টনারশিপ।
সুইডেন: সুইডেন লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসের তালিকায় সবথেকে উপরে থাকা একটি দেশ। এখানে লিভ টুগেদার যে আইনত নিয়ন্ত্রিত হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। সুইডেনে অবিবাহিত সঙ্গীদের বলা হয় সাম্ব। পরিণত বয়সে পৌঁছে সাম্ব হওয়াটা এখানে খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তাই বলে সুইডিশরা বিয়ে করেন না, এ রকমটাও কিন্তু নয়। অনেকেই একসঙ্গে বিশ-ত্রিশ বছর কাটিয়ে তার পরে বিয়ে করেন। তখন তাঁদের ছেলে-মেয়েরাও সেই বিয়ে দেখার সুযোগ পায়। তবে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সাম্ব আইনে জীবিত সাম্ব বিশেষ কিছু পাবেন না। যদি না বিশেষ ইচ্ছাপত্র থাকে সেই সাম্বের নামে। কিন্তু স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে এস্টেট ডিভিশন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যা কিছু একসঙ্গে থাকা বা ভোগ করার উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছিল, তার সমান ভাগাভাগি হবে। আয় ও ভরণপোষণের বৈষম্য এই ভাগাভাগিকে প্রভাবিত করতে পারবে না।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে সমগ্র ইউরোপেই বিবাহের প্রতি তরুণ প্রজন্মের এক চরম অনীহা দেখা দিয়েছে। যা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে জনসংখ্যার হ্রাসে। খুব দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক(পড়ুন দায়িত্ব) এড়াতেও লিভ টুগেদারে ঝুঁকছেন বহু মানুষ। অনেকে আবার একা থাকতে ও বেড়াতে পছন্দ করেন। কোনও রকম সম্পর্কে জড়াতে তাঁরা নারাজ। ইউরোপিয়ানরা যখন অনেক আগে থেকেই এ দিকে পা বাড়িয়ে রেখেছেন, তখন সেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে ভারতে বিবাহকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে সম্পর্কের অভিভাবক করে রাখা হয়েছিল দশকের পর দশক।
আইনি সম্মতি ছাড়া প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ দু'জন মানুষ এক ছাদের তলায় থাকতে পারবেন না। হয়তো এই কারণেই ভারতে এক প্রবল জনবিস্ফোরণ ঘটেছে, যার ফলস্বরূপ বিশ্বে সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশের তকমা জুটেছে। এই আগুনে ঘি ঢেলেছিল লিঙ্গবৈষম্য। তবে দু'জন মানুষের মধ্যে যে নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক, সেটাই হোক শেষ কথা। তাকে আইনের পরিচ্ছেদে বেঁধে রাখবে কার সাধ্য? এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।