West Bengal Municipal Election 2022

WB Municipal Election 2022: রাজধানী যখন সামান্য পুরসভা হয়ে যায়

বিগত দেড়শো বছরে এতগুলো পৌরপিতা অথচ মুর্শিদাবাদ সেই অন্ধকারেই । নবাবি আমলে গড়ে ওঠা এই রাজধানী-শহর আজ কেমন দমবন্ধ-করা অবস্থায় যেন ধুঁকছে।

Advertisement

নীহারুল ইসলাম

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২১:০৬
Share:

হাজারদুয়ারি... —নিজস্ব চিত্র

তখন দিল্লির মসনদে সম্রাট আওরঙ্গজেব। মারাঠা যুদ্ধের ফলে তাঁর রাজকোষে প্রচণ্ড অর্থ কষ্ট। যে বাংলা থেকে পর্যাপ্ত রাজস্ব পাওয়ার কথা, তা তিনি পাচ্ছেন না। হয় বর্গীরা সব লুটেপুটে নিয়ে যাচ্ছে না হয় তৎকালীন বাংলার সুবেদার তা আত্মসাৎ করছেন। অগত্যা সম্রাট ভরসা রাখলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ-র ওপর।

Advertisement

এর ফলে জাহাঙ্গীরনগরে মুর্শিদ কুলি খাঁ-র শুধু শত্রু বাড়ল না, তাঁকে গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হল। অগত্যা তিনি প্রাণে বাঁচাতে সম্রাটের সম্মতিক্রমে জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে চলে এলেন মখসুদাবাদে। যেখানে একটু একটু করে ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তুলছিলেন মাখসুদ খাঁন নামে এক ব্যবসায়ী। মুর্শিদকুলি খাঁ এখানে এসে যা দেখলেন তাতে তাঁর মনে হল, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ঠিকঠাক দেখভালের জন্য এর চেয়ে উত্তম জায়গা আর কোথায় হতে পারে! দু-পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দুই নদী। পূর্বদিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পদ্মা আর পশ্চিম দিক দিয়ে ভাগীরথী।

এটা একেবারে অষ্টাদশ শতাব্দীর (১৭০২) গোড়ার কথা। মুর্শিদ কুলি খাঁ এখানে এসে আস্থা রাখলেন স্থানীয়দের ওপর। এবং খুব অল্প দিনের মধ্যে এখানকার প্রজাদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠলেন। আর তাঁর নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হল মুর্শিদাবাদ। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী। তাঁর ইচ্ছাতেই তৈরি হল ‘কাটরা মসজিদ’। (১৭২৩-২৪) সাল। বহরমপুর-লালগোলা জাতীয় সড়কের ডান পাশে যা আজও বিদ্যমান। রোজ হাজারে হাজারে মানুষ আসেন দর্শন করতে। আর তাঁদের পদধূলি পড়ে তাঁর কবরের ওপর। মুর্শিদ কুলি খাঁ এটাই চেয়েছিলেন। সঙ্গে এই মুর্শিদাবাদের শান্তিসমৃদ্ধিও প্রত্যাশ্যা করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত বাস্তবে সেটা হয়নি।

Advertisement

লোক গবেষক শ্রী শক্তিনাথ ঝা তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখছেন, “ বণিকের রাজদন্ড হওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে ক্লাইভ দেখেছিল লন্ডনের চাইতে সমৃদ্ধ ও জন বহুল বন্দর কাশিমবাজারকে। বিজয়ী ইংরেজ বাহিনীর শোভা যাত্রা দেখেছিল পথের দুধারে দাঁড়িয়ে কাতারে কাতারে জনতা। তারা নাকি ইটের আধলা ছুঁড়লে ইংরেজ সেনাদের অস্তিত্ব থাকতো না। না, তারা কিছুই ছোঁড়েনি। তারা দেখেছিল আলিবর্দির সরফরাজকে হত্যা, মিরজাফরের সিরাজকে হত্যা, মিরজাফরকে সরিয়ে জামাই মিরকাশিমের এবং জামাইকে সরিয়ে মিরজাফরের সিংহাসন দখলের নাট্যরঙ্গ। ক্লাইভের মুর্শিদাবাদ লুন্ঠনের পর, তাদের তাবেদার গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, নশিপুরের দেবীসিংহ এবং রেজা খাঁ মহাশয় মারী মন্বন্তরে দেশ ও জনতাকে বিরান করে দিয়েছিল। সে এক কঠিন সময়। প্রাক্তন সেনা, কর্মচারী, ধনী-মানীরা কে কোথায় হারিয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের গঙ্গায় অস্ত যায় দেশের সুখ ও স্বাধীনতার সূর্য।”

মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়কালে ঘটে যায় এতকিছু। রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কলকাতায়। তারপর প্রায় এক শতাব্দী কেটে যায় প্রায় নিঃশব্দে। কোথায় কী হয় না হয় আমরা কিছু জানি না। কিন্তু ঠিক এই শতাব্দীকালের সন্ধিক্ষণে ঘটে যায় দেশজুড়ে ‘মহাবিদ্রোহ’।

না, এসব নিয়ে এই লেখা নয়। এই লেখা আজকের মুর্শিদাবাদ শহরকে নিয়ে। যেখানে ‘ওয়াসেফ্‌ মঞ্জিল’ আছে। বাংলার সবচেয়ে বড় ‘ইমামবাড়া’ আছে। ‘মতিঝিল’ আছে। ‘কাটরা মসজিদ’ আছে। ‘ত্রিপোলিয়া গেট’ আছে। সিরাজদ্দৌলার ‘মদিনা’ আছে। ‘চক্‌ মসজিদ’ আছে। ‘বাচ্চাওয়ালী তোপ’ আছে। ‘খোসবাগ’ আছে। ‘নবাব বাহাদুর উচ্চ বিদ্যালয়’ আছে। ‘আজিমুন্নেশার সমাধি’ আছে। ‘জাফরাগঞ্জ মোক্‌বারা’ আছে। ‘নশীপুর রাজবাড়ী’ আছে। ‘কাঠগোলা বাগান’ আছে। ‘ফৌতি মসজিদ’ আছে। ‘জগৎশেঠদের বাড়ী-মন্দির’ আছে। ‘জাহানকোষা কামান আছে’। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে একটি ‘পৌরসভা’ও আছে।

যার নাম ‘মুর্শিদাবাদ পৌরসভা’। হ্যাঁ, ভাবতেই অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, রাজধানী মুর্শিদাবাদ মাত্র একশো বারো বছরে মুর্শিদাবাদ পৌরসভায় পরিণত হয়। এর প্রতিষ্ঠার তারিখ ১ এপ্রিল, ১৮৬৯। আজকের দিনে যার বয়স ১৫১ বছর।
আসুন, একনজরে দেখে নেওয়া যাক এই পৌরসভার বর্তমান চেহারা। আয়তন ১৭.২৫ বর্গকিমি। জনসংখ্যা ৪৪০১৯ জন। ওয়ার্ড ১৬ টি। পাকা সড়ক ১৪৫ কিমি। ড্রেণ ৪৭ কিমি। হাসপাতাল ১ টি। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ৪ টি। উচ্চ বিদ্যালয় ৪ টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২ টি। প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৪ টি। শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ১০ টি।

জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এই পৌরসভার পুরপিতারা হলেন:

১। নবাব ইসকান্দার মির্জা (সুলতানসাহেব), ১৮৬৯ - ...

২। অজ্ঞাত, ... - ১৮৮৬

৩। বাবু প্রাণকুমার দাস, ... - ১৮৮৭

৪। কুমার রণজিৎ সিন্‌হা, ১৮৮৮ - ১৮৮৯

৫। অজ্ঞাত, ... - ১৮৯৪

৬। স্যার সৈয়দ ওয়াসিফ আলী মির্জা, ১৮৯৫ – ১৮৯৯

৭। অজ্ঞাত, ১৮৯৯ - ১৯০২

৮। কুমার রণজিৎ সিনহা, ১৯০৩ - ...

৯। নাসির আলী মির্জা, ... - ...

১০। এহসান আলী মির্জা, ... - ...

১১। কাইকৌস মির্জা, ... - ...

১২। সৈয়দ কাজেম আলী মির্জা, ১৯৩৯ - ৮/৬/ ১৯৪৯

১৩। নিহার বিন্দু দত্ত, ৯/৬/ ১৯৪৯ – ২১/১০/ ১৯৪৯

১৪। নিত্য গোপাল দাস, ২২/১০/ ১৯৪৯ – ১৪/৬/ ১৯৫১

১৫। সাহেবজাদা কাজী জয়নাল আবেদিন, ১৫/৬/ ১৯৫১ – ২২/৫/ ১৯৫৩

১৬। প্রবোধ কুমার রায়, ২৩/৫/ ১৯৫৩ - ৮/১/ ১৯৫৮

১৭। মোহান্ত গোবিন্দ দাস আচারী, ৯/১/ ১৯৫৮ - ৬/৪/ ১৯৬৪

১৮। বিজন কুমার সরকার, ৭/৪/ ১৯৬৪ – ২২/৭/ ১৯৮৬

১৯। স্মরজিৎ বসাক, ২৩/৭/ ১৯৮৬- ২৫/৫/ ২০০০

২০। আনন্দিতা হালদার, ২৬/৫/ ২০০০ - ৩/১/ ২০০১

২১। বিশ্বজিৎ ধর, ৪/১/ ২০০২ - ২১/৬/ ২০০৫

২২। শ্যামল মুখার্জী, ২২/৬/ ২০০৫–১৬/১০/ ২০০৬

২৩। সৈয়দ মেহেদী আলম মির্জা, ৩০/১০/ ২০০৬ - ২১/৬/ ২০১০

২৪। সৌমেন দাস, ২১/৬/ ২০১০- ৭/৪/ ২০১২

২৫। শম্ভুনাথ ঘোষ, ১৩/৪/ ২০১২ – ২৬/৫/ ২০১৫

২৬। বিপ্লব চক্রবর্তী, ২৭/৫/ ২০১৫ - ?

বিগত দেড়শো বছরে এতগুলো পৌরপিতা অথচ মুর্শিদাবাদ সেই অন্ধকারেই । নবাবি আমলে গড়ে ওঠা এই রাজধানী-শহর আজ কেমন দমবন্ধ-করা অবস্থায় যেন ধুঁকছে।

তবু এই ঐতিহাসিক শহরে আজও দেশবিদেশের বহু পর্যটক আসে। আস্তাবল থাকলেও ঘোড়া না থাকায় টাঙ্গার বদলে ঘুরে বেড়ায় অটো, টোটো চড়ে। চকবাজারে চোখ ধাঁধানো ত্রিপোলিয়া গেট কিংবা ওয়াসেফ মঞ্জিল কিংবা ইমামবাড়া, কিংবা কাটরা মসজিদ, কিংবা কাঠগোলা বাগান, কিংবা জগৎ শেঠদের বাড়ি-মন্দির দেখতে দেখতে আরও কত কত জীর্ণ দীর্ণবিদীর্ণ শীর্ণ গেট, মসজিদ, ইমারত তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তারা টের পায় না। যেমন চকবাজারে ত্রিপোলিয়া গেটের পাশে নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে তৈরি নহবৎখানার ভগ্নদশা আজ আর কারও চোখে পড়ে না। সুর শোনার তো কোনও প্রশ্নই নেই। যেমন চোখে পড়ে না মুন্নি বেগমের এস্টেটের ‘সাত সন্তানের জননীর গঙ্গা না পাওয়ার’ মতো করুণ অবস্থা। অথচ এই মহিলার আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জেলার নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন'।

ওয়াসেফ মঞ্জিলের গা-লাগা মুন্নি বেগমের হাভেলী খুঁজতে হয় দখলদারদের মেলে দেওয়া ভেজা কাপড়-চোপড়ের আড়াল থেকে। ভগ্ন প্লাস্টার-চটা প্রাচীরের যেটুকু চোখে পড়ে, দেখে মনে হয় মুন্নি বেগম তাঁর এস্টেটের অবহেলা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন। নাগিনা বাগের মসজিদটির কথা হয়ত আমাদের কারও মনে নেই। সরফরাজ খাঁ যেটির নির্মাণ করেছিলেন। সেটি এখন বাঁশ বাগানের আড়ালে ধীরে ধীরে দখলদারদের ব্যক্তি-সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে। যেমন স্টেশন রোডের একটি মসজিদের ঠিক দরজায় দরগা বানিয়ে দরগা-ভক্ত সেজে কেউ কেউ মসজিদটিরই দখল নিতে চাইছে।

যদিও আগামীতেও এই দখলদারি একই ভাবে জারি থাকবে বলেই মনে হয়, ক্ষমতায় যারাই আসুক না কেন!

‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে’ ...'

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement